বইয়ের অভাবে পড়তেন পঞ্জিকা, স্বামীই এনে দেন পছন্দের বই

আদর্শ একটা ধ্রুব ছাঁচ। যুগে যুগে তা অপরিবর্তনশীল। ক্ষেত্রবিশেষে সে কঠোর বাস্তব থেকেও দূরগামী। এই আদর্শের কথা তাই বলে না তাঁর লেখা। কী হওয়া উচিত সে কথা না বলে বরং কী হয়, কী হচ্ছে সে কথাই লিখেছেন তিনি। নিজেই বলেছেন, ‘যা হয় আমি তাই লিখি, কী হয় সেটাই বলবার, উচিত বলার আমি কে?’  এমন কথা তিনিই বলতে পারেন, যাঁর অস্থিমজ্জার সবটা পূর্ণ ছিল বাস্তবতায়। তিনি আমাদের সাধারণ জীবনের অলিতে গলিতে আতিপাতি করে খুঁজে বেড়িয়েছেন মানুষের আসল মনটাকে। বিশ শতকের বাঙালি মেয়ের সঙ্গত আশা পূরণের তিনিই কণ্ঠস্বর। আদতে তাই তিনিই 'আশাপূর্ণা'।

জীবন ঠিক যেমন, তেমন ভাবেই জীবনের কথা বলতে পারেন খুব কম মানুষই। আর এই প্রায় দুর্লভ কাজটিই আজীবন করে গেছেন আশাপূর্ণা দেবী। লেখার প্লট ভাববার জন্য তাঁকে হাতে পেন তুলে নিয়ে বন্ধ ঘরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়নি। রান্নাঘরে কুটনো কুটতে কুটতে, কড়াইতে ফোড়ন দিতে দিতেও আশাপূর্ণা দেবীর ভাবনায় তৈরি হয়ে গেছে গল্প, উপন্যাসের রেখাচিত্র। হলুদ মাখা আঁচল নিয়ে লেখার টেবিলে বসে এভাবেই তিনি লিখে গেছেন মেয়েদের কথা, সমাজের কথা সর্বোপরি জীবনের কথা। তাঁর জীবনই তাঁর লেখার বড়ো উপকরণ, অবলম্বন। 

১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের পৌষের দিনে উত্তর কলকাতায় মামারবাড়িতে জন্ম হয় আশাপূর্ণার। হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত ও সরলাসুন্দরী দেবীর ন'টি সন্তানের পঞ্চমতম ও মেয়ে সন্তান হিসেবে তৃতীয়, আশাপূর্ণার জন্মের পর তাঁর ঠাকুমা নিস্তারিণী দেবী চাননি আর কোনো কন্যা সন্তান তাঁদের ঘরে আসুক। মেয়ের স্বাদ যেন মিটেছে, আর  মেয়ের দরকার নেই, তাই হরেন্দ্রনাথের মা তাঁর এই নাতনির নাম রেখেছিলেন 'আশাপূর্ণা'। বোঝা যায়,  একপ্রকার অবহেলা নিয়েই আশাপূর্ণার জন্ম। অক্ষর পরিচয়েও বাড়ির তরফে এই অযত্ন, তাই পরিবারের ছোটো ছোটো ছেলে, দাদা ভাইদের উল্টোদিকে বসে তাদের পড়া নিবিষ্ট মনে দেখতে দেখতেই নিজের চেষ্টায়   আশাপূর্ণার পড়তে শেখা। প্রথাগত ভাবে স্কুলের পড়া শেখা তো দূরে থাক, কড়া, রক্ষণশীল সে পরিবারে বিয়ের আগে পর্যন্ত চৌকাঠ পেরনোও ছিল নিষিদ্ধ। অথচ, সময়ের কী অহৈতুকী পুরস্কার, এই আশাপূর্ণাই  তাই একদিন তিন হাজারের বেশি ছোটোগল্প, আড়াইশোর ওপর উপন্যাস, ছোটোদের জন্য, বড়োদের জন্য লেখা অসংখ্য রচনার অধিকারী হলেন। তথাকথিত পাশের পড়া না শেখা এই আশাপূর্ণাকে এখন পড়ানো হয় স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে। 'দেশিকোত্তম', 'জ্ঞানপীঠ' সহ বহু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া সাম্মানিক ডক্টরেটের মালকিন এই আশাপূর্ণা দেবী যেন মা সরস্বতীর স্টেনোগ্রাফার। 

খুব নিয়মনিষ্ঠ পরিবার, আচারসর্বস্ব ঠাকুমার কড়া শাসন, ছবি আঁকিয়ে বাবার নিজের কাজ নিয়ে মেতে থাকা,  এসবের মধ্যেও এক দক্ষিণখোলা জানলা ছিল কিশোরীবেলার আশাপূর্ণার। সেই জানলা তাঁর মা সরলাসুন্দরী ও তাঁর সাহিত্যপ্রীতি। বহুবার আশাপূর্ণা দেবী বলেছেন তাঁর মায়ের কথা, বলেছেন মায়ের জন্যই লিখতে শেখা, পড়তে শেখা। প্রচুর বই আসত বাড়িতে, তাছাড়াও তিনটে লাইব্রেরি থেকে হত বই-এর জোগান। আশাপূর্ণা বলছেন, '’মায়ের বই পড়া মানে সে প্রায় কুম্ভকর্ণের খিদের মতোই। আর আমাদেরও স্কুলের বালাই নেই।  সেইসব বইগুলো নির্বিচারে পড়ে ফেলতাম... বই পড়াটা ভাত খাওয়ার মতোই অপরিহার্য ছিল।’ আর এইভাবে পড়তে পড়তেই 'শিশুসাথী' পত্রিকায় ছাপা হল কিশোরী আশাপূর্ণার লেখা প্রথম কবিতা 'বাইরের ডাক'।  পত্রিকার সম্পাদক রাজনারায়ণ চক্রবর্তী সে-লেখা পড়ে ছোট্ট আশাপূর্ণাকে সত্যিই যেন বাইরের পৃথিবীতে আসার ডাক পাঠালেন, বললেন, ‘...আরও লেখা দিতে পারবে? গল্প লিখতে জানো?' এই মানুষটির কাছে তাই আজীবন কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন আশাপূর্ণা, বারবার জানিয়েছেন, এই প্রাথমিক উৎসাহটুকু না পেলে কোনোদিনই তার লেখক হওয়া হত না। 

একজন চিত্রগ্রাহক যেভাবে একটি দৃশ্যকে হুবহু তার ক্যামেরায় তুলে ধরেন, তেমনি যথাযথ আশাপূর্ণা দেবীর লেখা। নানা 'অ্যাঙ্গেল' থেকে জীবনের ছবি বারবার তুলে ধরে তাঁর কলম। পরিবারে ছোটো থেকে মেয়েদের ওপর সমাজ সংসারের বাধ্যত চাপিয়ে দেওয়া যে নিয়মের মধ্যে দিয়ে তিনি বেড়ে উঠেছেন সে কথা কেমন ছবির মতন হয়ে ওঠে আশাপূর্ণার 'ট্রিলজি', 'প্রথম প্রতিশ্রুতি', 'সুবর্ণলতা', 'বকুলকথা'য়। মেয়েদের সব বিষয়েই আসলে কথা বলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সর্বোপরি পুরুষ, সর্বকাজে মেয়েদের এই পরজীবী জীবন, অনধিকার, অদরকার আশাপূর্ণার লেখায় 'মেয়েমানুষের দাবি' তৈরি করেছে। তাঁর উপন্যাসের 'সত্যবতী', 'সুবর্ণলতা', 'বকুল' সেই দাবির কথাই নানাভাবে বলে, অধিকার অর্জন করে তারা নিজেদের ব্যক্তিত্ব ও যোগ্যতায়। কিন্তু তা বলে পক্ষপাতী নন আশাপূর্ণা, তাঁর লেখায় তাই উঠে আসে, ‘নারী ছলনাময়ী, নারী জন্ম অভিনেত্রী। কিন্তু সে কি শুধু পুরুষজাতিকে মুগ্ধ করবার জন্যে? বিভ্রান্ত করার জন্যে? বাঁচবার জন্যে নয়? আশ্রয় দেবার জন্য নয়?’ আশাপূর্ণা বলেন, স্বামী সন্তান সবকিছু নিয়ে মেয়েদের যে অতিরিক্ত আসক্তি তা যতদিন না তারা ত্যাগ করতে পারবে, ততদিন মেয়েদের কাঙ্খিত মুক্তি আসবে না। সারাজীবন আলোর পৃথিবীকে অন্ধকারের বোবাকান্নার খবর এনে দেওয়া, সামাজিক পালাবদল দেখা আশাপূর্ণা দেবী তাই কিন্তু তথাকথিত আধুনিক মেয়ের উন্নাসিকতাকে মানতে পারেননি কোনোমতেই। কোনো 'ইজমে'র পথে না গিয়েও সত্যিকারের নারীমুক্তির প্রসঙ্গে তাই আজও হয়তো আমরা আশাপূর্ণা দেবীর মুখাপেক্ষী।   

মনের কারবারি আশাপূর্ণা। তাই মানবমনের গোপন, গহীন কুঠুরিতে তাঁর অবাধ যাতায়াত। নতুন যুবতী বৌ-এর তার স্বামীর ওপর প্রভাবে, সেই পুত্রের মায়ের মনের কেমন অবস্থা হয়, বিধবা পুত্রবধূকে দেখে কোন পৈশাচিক উল্লাসে মেতে ওঠে সেই মায়ের মন, ধর্ষিতা অথচ জীবিত মেয়েকে কেন মৃত বলে পাড়ার লোকের কাছে ঘোষণা করে হতভাগ্য বাবা-মা – এইসব কথার পুঙ্খনাপুঙ্খ ময়নাতদন্ত করেন আশাপূর্ণা দেবী তাঁর লেখায়। তাঁর 'ছিন্নমস্তা', 'ভয়', 'পদাতিক', 'ইজিচেয়ার'এর মত অজস্র গল্পে তথাকথিত শিক্ষায় 'ফ্রয়েডের মনস্তত্ত্ব' না জানা আশাপূর্ণা এভাবেই মনের পর্দার পরত একের পর এক খুলতে থাকেন। 

আরও পড়ুন
‘সাগরের মৃত্যু নেই, সে অমর’, সাগর সেনের অকালপ্রয়াণে লিখেছিলেন সুচিত্রা মিত্র

নিজের লেখক জীবনে স্বামীর অকুণ্ঠ সহযোগিতা পেয়েছিলেন আশাপূর্ণা। কৃষ্ণনগরে শ্বশুরবাড়িতে এসে প্রথমে পঞ্জিকা ছাড়া আর কোনো বই না দেখে কাজের অবসরে সেই পঞ্জিকাই পড়তেন পড়ুয়া আশাপূর্ণা। তা দেখে তাঁর স্বামী কালী দাশগুপ্ত প্রথমে বই এনে দেন বাড়িতে, তারপর ধীরে ধীরে স্ত্রীর লেখার সুবিধার্থে কৃষ্ণনগরের বাড়িটাই তুলে আনেন কলকাতায়। এক্কেবারে ঘরোয়া এই মানুষটি তাই তাঁর লেখালেখিকে সংসারের বাইরে কোন ভিনগ্রহের কাজ বলে দেখেননি। ঘরে কেউ এসেছে, চায়ের জল চাপিয়ে দিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে বলতেও আশাপূর্ণা ভাবতে পেরেছেন কাজের জন্যেই সদ্য ফেলে আসা তাঁর লেখার টেবিলকে। লেখা আর সংসার কোথাও কোনো গণ্ডি বেঁধে রাখেননি দুই জগতে। আজও যেসব মেয়েরা শত প্রতিকূলতার ওপারে গিয়েও সব্যসাচীর ভূমিকায় রান্না করে, অফিস করে, পত্রিকা সম্পাদনা করে, বই লেখে, লেখার জন্য বাঁচে, বাঁচার জন্য লেখে, পুরুষতান্তিক সমাজের সবরকম অত্যাচার, অসভ্যতার যোগ্য জবাব দেয়, যোগ্যতার নতুন নতুন সংজ্ঞা তৈরি করে, তাদের সবার কাছে চিরকালের আইডল এই মানুষটি, রবীন্দ্রনাথের 'আশাপূর্ণা- সম্পূর্ণা'। কাঁটা বিছানো পথেও উত্তরণের হদিশ দিতে, যে আশাপূর্ণারা প্রতিদিন জন্মান, আজ তাদেরই আশাপূরণের প্রতিভূ হয়ে উঠেছেন আশাপূর্ণা দেবী।

তথ্যসূত্রঃ 'শতবর্ষের আলোকে আশাপূর্ণাদেবী'

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
অস্কারের মনোনয়নে প্রথম সিনেমাই; রক্ত দিয়ে চিঠি লিখতেন মহিলা-ভক্তরা!

More From Author See More