রাবণবধের আগে দশভূজার পুজো করেছিলেন স্বয়ং রামচন্দ্র। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে রামের এই বিজয়োৎসব উদযাপিত হয় বিভিন্নভাবে। বাংলা কিংবা ওড়িশায় যেমন দশভূজার প্রতিমা নিরঞ্জনের মধ্যে দিয়ে পালিত হয় বিজয়া দশমী, তেমনই রাবণের কুশপুতুল পুড়িয়ে হিন্দিবলয়ে পালিত হয় দশেরা (Dussehra)। তবে উত্তরভারতের কুল্লু উপত্যকায় দশেরার নিয়ম আরও খানিকটা আলাদা। শুধু রামচন্দ্রের মূর্তিই নয়, বরং সাতদিন ধরে সেখানকার রাস্তায় নামতে দেখা যায় কয়েকশো দেব-দেবীর ঢল।
হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন কয়েকশো দেবদেবী। তাঁদের পালকিতে চড়িয়ে রাস্তায় মহামিছিলে সামিল হন স্থানীয় বাসিন্দারা। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তো বটেই, এমনকি বিদেশ থেকেও লক্ষাধিক মানুষ ভিড় জমান ‘কুল্লু দশেরা’-খ্যাত (Kullu Dussehra) এই উৎসবে সামিল হতে। কিন্তু দশেরার এমন অদ্ভুত নিয়ম কেন কুল্লুতে?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে ফিরে যেতে হবে প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো এক জনশ্রুতিতে। সে-সময় কুল্লুর রাজসিংহাসনে ছিলেন জগৎ সিং। তিনি খবর পান কুল্লুর টিপরি গ্রামের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণের কাছেই লুকনো আছে অমূল্য রত্ন— এক বাটি বিরল মুক্তো। এই মুক্তোর লোভেই তাঁর বাড়িতে আক্রমণ করেন রাজা জগৎ সিং। তবে মুক্তোর নাগাল পাননি তিনি। রাজার সেনাবাহিনীকে দূর থেকে দেখে নিজেই নিজের গায়ে আগুন ধরিয়েছিলেন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ। এই ঘটনার জন্য দীর্ঘদিন আত্মদংশনে ভুগেছিলেন রাজা জগৎ সিং। শেষে তাঁকে এই মানসিক পীড়া থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য রঘুনাথের মূর্তি স্থাপন ও পুজো করার পরামর্শ দেন কৃষ্ণ দত্ত নামের এক সন্ত।
হ্যাঁ, কৃষ্ণ দত্তের কথা অনুযায়ী অযোধ্যা থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল পাথরের রাম-মূর্তি। প্রথমবারের জন্য কুল্লুতে পা দিয়েছিলেন রামচন্দ্র। কিন্তু রাজ্যে রামচন্দ্রের পুজোর প্রচলন করলেও, প্রজাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেননি তিনি। বরং, চেয়েছিলেন সমস্ত গ্রামবাসীই যেন দশেরার উৎসবে সামিল হন তাঁদের নিজের নিজের কুলদেবতাকে নিয়ে।
সেই রীতি চলছে আজও। একদিকে যেমন জগৎ সিং-এর আনা পাথরের রঘুনাথ মূর্তি রথে চাপিয়ে রাস্তায় নামেন গোটা রাজ পরিবার, তেমনই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই উৎসবে নিজেদের কুলদেবতার মূর্তি নিয়ে হাজির হন গ্রামবাসীরাও। শোভাযাত্রার আবহে আলোয় আলোয় রঙিন হয়ে ওঠে কুল্লুর রাস্তাঘাট। গম গম করে বাদ্যির আওয়াজে। পুজোর আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গেই আয়োজিত হয় ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধানের প্রতিযোগিতা এবং কারু ও লোকশিল্পের প্রদর্শনীও। বিজয়া দশমী থেকে শুরু করে টানা সাত দিন চলে এই অনুষ্ঠান। শেষ দিনে মাছ, মহিষ, মোরগ, ভেড়া ও কাঁকড়া বলির মাধ্যমে শেষ হয় এই পরবের।
১৯৭২ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছিল কুল্লুর এই শতাব্দীপ্রাচীন অনুষ্ঠান। তারপর থেকেই ক্রমশ জনপ্রিয়তা বেড়েছে কুল্লু দশেরার। বেড়েছে বিদেশিদের ভিড়ও। চলতি বছরেও অন্ততপক্ষে ৪ থেকে ৫ লক্ষ মানুষ এই উৎসবে অংশ নিয়েছেন বলেই অনুমান স্থানীয়দের…
Powered by Froala Editor