মূর্তি ছিল না কালীর, প্রথম তৈরি করলেন নবদ্বীপের বঙ্গসন্তান

বাংলার বৈশিষ্ট্যের পরিচয় আমরা পাই- রঘুনাথ শিরোমণির নব্যন্যায়ে, গৌরাঙ্গের দ্বৈতাদ্বৈতবাদে, কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের তন্ত্রসারে, রঘুনন্দনের স্মৃতিতে এবং জীমূতবাহনের দায়ভাগে।

ওপরের কথাগুলি লিখছেন সুভাষচন্দ্র বসু। মধ্যযুগের বাংলার উৎকর্ষ বোঝাতে, এইসব দিকপালের নাম নিচ্ছেন তিনি। কিন্তু এঁদের মধ্যে এক গৌরাঙ্গ তথা চৈতন্য ছাড়া বাকি প্রত্যেকেই সাধারণ বাঙালির কাছে প্রায় অপরিচিত। কারা তাঁরা? কী ছিল তাঁদের অবদান?

বাকিদের কথা আজ থাক। বরং কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকে নিয়েই এগোই। শোনা যায়, তিনি চৈতন্যের সহপাঠী ছিলেন। রঘুনন্দন শিরোমণি, রঘুনন্দন ভট্টাচার্য ও চৈতন্য একই টোলে শাস্ত্র অধ্যয়ন করতেন নবদ্বীপে। শোনা যায়, এককালে চৈতন্য ও কৃষ্ণানন্দের মধ্যে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। পরবর্তীকালে চৈতন্য সখীভাবে কৃষ্ণভজনের পথে গেলে, দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য হয় ও কৃষ্ণানন্দ শাক্ত পথ অবলম্বন করেন।

এই মত প্রচলিত থাকলেও, বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ থেকে জানা যায়, চৈতন্যের মৃত্যুর অন্তত ৭০ বছর পরে জন্ম কৃষ্ণানন্দের। আনুমানিক ১৬০৫-১৬১০ সালে নবদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। চৈতন্য-পরবর্তী যুগে, যখন ধীরে-ধীরে বৈষ্ণব-আধিপত্য কমে আসছে নবদ্বীপে, তেমনই এক সময়ে আবির্ভাব কৃষ্ণানন্দের। বাংলায় শক্তিচর্চাও তখন বিক্ষিপ্ত, অধোগামী। হাল ধরলেন তিনিই। বিভিন্ন তন্ত্রশাস্ত্র ঘেঁটে, রচনা করলেন ‘তন্ত্রসার’।

তবে এসব পেরিয়েও, কৃষ্ণানন্দ আলোচিত হন অন্য একটি কারণে। বর্তমানে যে কালীমূর্তি প্রচলিত, তার রূপ দেন তিনিই। তার আগে যন্ত্র ও ঘটে আরাধনা হত দেবীর। কৃষ্ণানন্দই স্বপ্নাদেশ পেয়ে নির্মাণ করেন প্রচলিত কালীমূর্তি। কেননা সাধারণ মানুষ নিরাকার সাধনার মর্ম বুঝবে না। অতএব মৃণ্ময়ী মূর্তিই হোক আরাধ্যা।

শোনা যায়, দেবী নাকি স্বপ্নে কৃষ্ণানন্দকে বলেন, পরদিন সকালে প্রথম যে নারীকে দেখবেন কৃষ্ণানন্দ, তাঁর আদলেই নির্মিত হবে মূর্তি। সেইমতো পরেরদিন গঙ্গাস্নানে বেরিয়ে কৃষ্ণানন্দ দেখেন এক গোপবধূকে। তাঁর ডান পা একটি বারান্দার ওপর তোলা, বাঁ পা মাটিতে। ডান হাতে গোবরের তাল, বাঁ হাত উঁচুতে তুলে ঘুঁটে দিচ্ছেন বেড়ার গায়ে। চুল খোলা, পরনে একটি ছোট শাড়ি। সেই গোপবধূ ছিলেন শ্যামবর্ণা। অত সকালে কৃষ্ণানন্দকে দেখে, লজ্জায় জিভ কেটে পিছন ফিরে দাঁড়ালেন সেই রমণী।

স্বপ্নাদেশ মনে পড়ে কৃষ্ণানন্দের। তারপর, সেই গোপবধূর আদলেই তৈরি করেন কালীমূর্তি এবং সর্বত্র প্রচলন করেন তা। কালীপূজার রাতে আলো দিয়ে পথঘাট সাজানোর নিদান, এমনকি এই দিনটিকে 'আলোর উৎসব' হিসেবেও পরিচিতি দেন কৃষ্ণানন্দই। যদিও প্রথম দিকে অনেকেই তাঁর প্রচলিত কালীপূজাকে সমর্থন করেননি। পরবর্তীকালে, অষ্টাদশ শতকে নদীয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র প্রথম বৃহদাকারে প্রচলন করেন মূর্তিতে কালীপূজার। পরবর্তীকালে, উনবিংশ শতকে কৃষ্ণচন্দ্রের উত্তরসূরিরা সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেন এই পূজা। কলকাতাতেও ঢেউ লাগে তার। সেই থেকেই, দূর্গাপূজার পাশাপাশি কালীপূজাও হয়ে আসছে মহা আড়ম্বরে।

ভাবতে অবাক লাগে, যে নবদ্বীপ বৈষ্ণব তীর্থগুলির মধ্যে অন্যতম হিসেবে স্বীকৃতি পায় আজও, সেই নবদ্বীপেরই আরেক সন্তান কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ বাংলার তন্ত্রসাধনার অন্যতম পথনির্দেশক। নদীয়াকে যে অনেকে বাংলার মধ্যযুগের ধর্ম ও সংস্কৃতির রাজধানী বলেন, তা নিছক অবহেলার কথা নয়!

ছবি ঋণ - ইউটিউব