ঘাতক ‘ভূতুড়ে’ ডাক্তাররা, প্লাস্টিক সার্জারিতে প্রাণ হারাচ্ছেন বহু কোরিয়ান

কৃত্রিমভাবে সুন্দর হওয়ার চাহিদা দিনে দিনেই বেড়ে চলেছে পাল্লা দিয়ে। আর তার অন্যতম হাতিয়ারই হল প্লাস্টিক সার্জারি। বলিউড, হলিউড তারকারা তো বটেই, সাধারণ মানুষও রূপ ফেরাতে এখন ক্লিনিকের দ্বারস্থ হচ্ছেন হামেশাই। তবে দেখতে গেলে গোটা বিশ্বের মধ্যে প্লাস্টিক সার্জারির রাজধানী হল দক্ষিণ কোরিয়া। সেখানে প্রতি বছর ১০ লক্ষেরও বেশি মানুষ প্লাস্টিক সার্জারির শরণাপন্ন হন। আর এই বিষয়টি সুযোগ নিয়েই চলছে এক রমরমা ব্যবসা। মাঝেমাঝেই তা হয়ে উঠছে প্রাণঘাতী।

‘ঘোস্ট ডক্টর’— কথাটির সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার সকলেই অল্প-বিস্তর পরিচিত এখন। কিন্তু এই বিষয়টি কী? না, কোনো ভৌতিক চিকিৎসক নয়। যে সকল চিকিৎসকদের সেভাবে কোনো প্রথাগত শিক্ষা নেই প্লাস্টিক সার্জারির অথবা যে সকল চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্র-ছাত্রী এখনও সম্পূর্ণ করে উঠতে পারেননি পাঠক্রম— তাঁরাই ঘোস্ট ডক্টর। লাভের পরিমাণ বাড়াতে এখন তাঁদের দিয়েই সার্জারি করানো হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার ক্লিনিকগুলিতে। আসলে প্রথিতযশা সার্জেনদের অস্ত্রোপচার পিছু বেতন অনেকটাই বেশি। ফলত নামমাত্র তাঁদের সার্জারির সময়ে রেখে জুনিয়রদের দিয়েই এই কাজ করাচ্ছে ক্লিনিকগুলি।

এই বিষয় যে একেবারে নতুন, তা নয়। ২০১৪ সাল থেকেই বিক্ষিপ্তভাবে একাধিক অভিযোগ উঠে আসছে ঘোস্ট ডক্টরদের নিয়ে। এখনও পর্যন্ত প্রায় সহস্রাধিক মানুষের প্রাণ গেছে এই অনভিজ্ঞ চিকিৎসকদের কারণে। অনেকের ক্ষেত্রে আবার প্রাথমিক অস্ত্রোপচার সফল হলেও কিছুদিন পর থেকেই দেখা গেছে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। তবে সমাজে সম্মানহানির কথা ভেবেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিষয়টিকে সামনে আনেন না গ্রাহকরা। আর আনলেও তা আদালতে প্রমাণ করা বেশ শক্ত কাজ। কারণ অধিকাংশক্ষেত্রেই সিসিটিভি ক্যামেরা ব্যবহার করা হয় না ক্লিনিকগুলিতে।

অথচ, সরকারি নিয়মানুযায়ী সিসিটিভি ক্যামেরা থাকা বাধ্যতামূলক প্রতিটি অপারেশন থিয়েটারে। পাশাপাশি সার্জেনের কাছে লাইসেন্স না থাকলে হতে পারে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডও। কিন্তু সেই আইন রয়ে গেছে খাতায়-কলমেই। তবে সম্প্রতি এই সমস্যাটিকে নিয়ে জোরালো হল অভিযোগ। হাতে-নাতে প্রমাণও মিলল তার। ২০১৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ারই একটি ক্লিনিকে প্লাস্টিক সার্জারি করিয়েছিলেন এক বছর পঁচিশের যুবক। তবে অস্ত্রোপচারের পর আর ফিরে আসা হয়নি তাঁর। 

তখনই আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তাঁর মা। প্রশাসনিক চাপ দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত প্রকাশ্যে এসেছে সেই ভিডিও ফুটেজ। সেখানেই ধরা পড়ে প্রধান সার্জেন খানিকটা কাজ দেখেই সরে পড়েছেন সার্জারি থেকে। বাকি অস্ত্রোপচারের দায়িত্বে ছিলেন ঘোস্ট ডক্টররা। যে অপারেশন মাত্র দেড় ঘণ্টার মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার কথা, সেটাই চলেছিল প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে। রোগীর অনবরত রক্তক্ষরণেও খুব একটা হেলদোল দেখা যায়নি কর্তৃপক্ষের মধ্যে।

সম্প্রতি প্রকাশ্যে আসা এই ভিডিও-ই নতুন করে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। প্রশ্ন উঠছে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে। দক্ষিণ কোরিয়ায় বছরে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের ব্যবসা চলে শুধুমাত্র প্লাস্টিক সার্জারি নিয়ে। আর সেখান থেকে বড়ো অঙ্কের কর সরকারি খাতে ঢোকে বলেই কি বিষয়টাকে এড়িয়ে যাচ্ছে প্রশাসন? উত্তর জানা নেই। সমস্যাটি নিয়ে বিষদে তদন্তের আশ্বাস দিয়েছে কোরিয়ার আদালত। তবে সার্বিকভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে কসমেটিক সার্জারির চাহিদা না কমলে, এই সমস্যার সমাধান খুঁজে বার করা কঠিন হবে বলেই ধারণা বিশেষজ্ঞদের…

Powered by Froala Editor