ষাটোর্ধ্ব রবীন্দ্রনাথ অভিনয় করছেন রঘুপতি চরিত্রে। মঞ্চে অভিনীত হচ্ছে তাঁর ‘বিসর্জন’ নাটক। আর উপরে ‘ড্রেস সার্কেল’-এ বসে সেই অভিনয় দেখছেন দর্শকরা। রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠ দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে পৌঁছচ্ছে শ্রোতাদের কাছে। মুগ্ধ হয়ে দেখছেন কবিগুরুর অভিনয়। এমনও হতে পারে!
আরও পড়ুন
অবাঙালির কাছে বিক্রি বাড়ি, মৃত্যুর চার বছরের মধ্যেই ভাঙা হল অমল দত্তের বাসগৃহ
যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, তখন নাটকে কোনো মাইকের ব্যবহারের বন্দোবস্ত ছিল না। আর যে হলে এই নাটক অভিনীত হচ্ছে, সেখানে কোনো মাইকের প্রয়োজনও ছিল না। গোলাকৃতি হলের ভিতরে দাঁড়ালে দেখার বা শোনার কোনো অসুবিধা তো হয়ই না, মনে হয় যেন নতুন কোনো প্রযুক্তির প্রয়োজনও নেই। সারা হল যেন গমগম করে ওঠে। কলকাতার ‘এম্পায়ার থিয়েটার’-এ ছিল এমনই ঐতিহাসিক স্থাপত্য। কলকাতার নাট্যজগতে তখন একটি পরিচিত নাম ‘এম্পায়ার থিয়েটার’। আর কিছুদিনের মধ্যেই সেই হল পরিচিত হবে ‘রক্সি সিনেমা’ নামে। সাদা মার্বেল পাথরের সিঁড়ির নীচে চাপা পড়ে আছে শতাব্দী প্রাচীন ইতিহাস। ইতিহাসের সেই লম্বা ইনিংস শেষ হয়ে গেল। বন্ধ হয়ে গেল ‘রক্সি সিনেমা’।
আরও পড়ুন
কলকাতার কেবিনগুলিতে বসত বিপ্লবীদের বৈঠক, ছিল পালানোর গোপন পথও
কলকাতার থিয়েটারের চর্চা তখন সারা পৃথিবীর কাছে পরিচিত। এই তো কিছুদিন আগে শেষ হয়েছে গিরিশ ঘোষের রাজত্ব। কলকাতার থিয়েটারে তখন একঝাঁক তারকা। তখন ধর্মতলার কাছে তৈরি হল এই ‘এম্পায়ার থিয়েটার’। তৈরি করলেন মরিস ব্যান্ডম্যান। সারা পৃথিবীজুড়ে তিনি তৈরি করছেন নাটকের বাজার। একদম গোড়ার দিকেই মঞ্চে পা রাখলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯২৩ সালে ‘বিসর্জন’ নাটকের অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে। রবীন্দ্রনাথের অনেক নাটকই এখানে অভিনীত হয়েছে। ১৯৩৬ সালে ‘চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্যনাট্য চলেছে পরপর তিনদিন। এখানে অভিনয় করেছেন নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুড়িও।
আরও পড়ুন
১৮৮১ নয়, তার পাঁচ বছর আগেই কলকাতা শুনেছিল প্রথম টেলিফোনের আওয়াজ
নাটকের পাশাপাশি কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হল সিনেমার শো। চল্লিশের দশকের গোড়ায় এই থিয়েটারের নাম পাল্টে রাখা হয় ‘রক্সি সিনেমা’। কলকাতা শহরের অন্যতম পুরনো সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমা হল এটা। প্রথম শো ছিল অশোক কুমারের ‘নয়া সংসার’। সেটা ১৯৪১ সাল। চলেছিল ১৭ সপ্তাহ। পরের সিনেমা ‘বসন্ত’ চলেছিল ৫০ সপ্তাহ। শোনা যায়, নেতাজি সুভাষচন্দ্রও সিনেমা দেখতে এসেছিলেন এখানে। সম্ভবত সেটি অশোক কুমারেরই আরেক সিনেমা ‘কিসমত’। রক্সিতে ‘কিসমত’ সিনেমার ১৮৪ সপ্তাহ টানা শো’য়ের রেকর্ড আছে।
আরও পড়ুন
কলকাতায় ইংরেজদের তৈরি প্রথম গির্জা আজ বিস্মৃতির অতলে
কলকাতার ইতিহাসের নানা দিকপালকে একটি সুতোয় মিলিয়ে দিতে পেরেছিল রক্সি সিনেমা। নয় নয় করে বয়স তো তার কম হল না। স্বীকৃতি পেয়েছে প্রথম সারির হেরিটেজ বিল্ডিং-এরও। তবে উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ নেই বলে অভিযোগ উঠেছে বহুবার। বিতর্ক উঠেছিল ঐতিহাসিক গম্বুজ ভেঙে ফেলা নিয়েও। আর এখন তো সিনেমা হলটাই বন্ধ হয়ে গেল পাকাপাকিভাবে।
আরও পড়ুন
শতবর্ষ আগে ভিক্টোরিয়ার চূড়ায় নেমে এসেছিল পরী, ঘুরে-ঘুরে দেখত গোটা কলকাতা
১২ মার্চ ২০২০, বৃহস্পতিবার; রক্সি সিনেমা হলের শেষ শো প্রদর্শিত হয়ে গেল। সেইসঙ্গে শেষ হল ইতিহাসের একটা লম্বা ইনিংস। বৃহস্পতিবার যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা সেই ইতিহাসের আঁচ পেলেন। যে ইতিহাসের সঙ্গে মিলে গিয়েছে রবীন্দ্রনাথ, শিশির ভাদুড়ি থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বা অশোক কুমারের নাম। আর বাকিটা শতাব্দীপ্রাচীন সাদা মার্বেল পাথরের সিঁড়ির নিচে চাপা পড়ে থাকবে। কতদিন থাকবে, সে-কথাও বলা যাচ্ছে না। শোনা যাচ্ছে কিছুদিনের মধ্যে ভেঙে ফেলা হবে ঐতিহাসিক বাড়িটিও।
আরও পড়ুন
বিপ্লবীর পরামর্শে শুরু প্রকাশনা, শতবর্ষের দোরগোড়ায় কলকাতার ডি এম লাইব্রেরি
পরিণতি যাই হোক, রক্সি সিনেমার বন্ধ হয়ে যাওয়া আসলে কলকাতার সিনেপ্রেমীদের কাছে মস্ত এক আঘাত। শুধু তো হল নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাসও। একের পর এক ঐতিহাসিক সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাওয়ার সাক্ষী থেকেছে কলকাতা। সেই তালিকাতেই যুক্ত হল রক্সির নাম…