ক্রেতার আনাগোনা হাতে গোনা, নেই বিজ্ঞানাচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের আবিষ্কৃত শরবতও

বেঞ্চে এসে বসতে বসতেই এক যুবতী অর্ডার দিলেন, ‘এক গ্লাস ডাবের সরবৎ’। হতাশ গলায় কর্মচারী জানালেন, ‘ডাবের সরবৎ তো হবে না।’ হ্যাঁ, এভাবেই একের পর এক ক্রেতাকে হতাশ করতে বাধ্য হচ্ছে প্যারামাউন্ট। কলেজ স্কোয়ারের পিছনে শতাব্দীপ্রাচীন এই শরবতের দোকানটির সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয় ডাব শরবৎ। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে যে ডাবেরই জোগান নেই। ফলে দোকানের ঐতিহ্যে ছেদ পড়েছে, এবং ১০২ বছরের ইতিহাসে এমন ঘটনা এই প্রথম।

১৯১৮ সালে নীহাররঞ্জন মজুমদারের হাতে পথচলা শুরু প্যারামাউন্টের, থুরি, প্যারাডাইসের। তবে শরবতের দোকানের আড়ালে আসলে চলত স্বদেশি কর্মকাণ্ড। বিপ্লবী বাঘাযতীন থেকে শুরু করে নেতাজি সুভাষচন্দ্র পর্যন্ত অনেকেই আসতেন সেই সময়। কিন্তু ইংরেজ পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে বেশিদিন সেই কাজ চলল না। ফলে এক দশকের মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেল দোকান। আবার খুলল ১৯৩৭ সালে। এবারে নাম হল ‘প্যারামাউন্ট’। “সেই একবারই একটানা বন্ধ ছিল দোকান। তারপর কখনও বাজার মন্দা যায়নি।” বলছিলেন দোকানের বর্তমান কর্ণধার তথা নীহাররঞ্জন মজুমদারের নাতি পার্থ মজুমদার।

করোনা পরিস্থিতিতে সমস্ত ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেই মন্দা দেখা দিয়েছে। বাদ যায়নি প্যারামাউন্টও। “হঠাৎ লকডাউনে বন্ধ করে দিতে হল দোকান। কর্মচারীদের মাইনে কীভাবে দেব, সেটাও বুঝে উঠতে পারিনি। অবশেষে ২৯ জুন দোকান খোলার অনুমতি পেলাম। কিন্তু তার পরেও দোকানের অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছেন…” বলে ফাঁকা বেঞ্চগুলির দিকে হাত বাড়িয়ে দেন পার্থ মজুমদার। ইতিমধ্যে চারজন ক্রেতা ডাবের শরবৎ না পেয়ে ফিরে গিয়েছেন।

জনপ্রিয়তা তো বটেই, ইতিহাসের নিরিখেও প্যারামাউন্টের সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছে ডাবের শরবৎ। পার্থ মজুমদার বলছিলেন, এই শরবতের রেসিপি নাকি দিয়েছিলেন স্বয়ং বিজ্ঞানাচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। ডাবের জল তো বাঙালির চিরকালের প্রিয় পাণীয়। কিন্তু তার সঙ্গে যে ডাবের শাঁস মিশিয়ে এমন সুস্বাদু শরবৎ বানানো যায়, সেটা নীহাররঞ্জন মজুমদারকে শিখিয়েছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র। পরে যে অসংখ্য তারকার সমাগম ঘটেছে এই দোকানে, তাঁদেরও প্রিয় পানীয়ের তালিকায় ছিল ডাবের শরবৎ। আর সেই তালিকায় কাজি নজরুল ইসলাম, সত্যজিত রায় থেকে শুরু করে উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, পাহাড়ি সান্যাল; বাদ যাননি কেউই। দোকানে এমন শতাধিক নামের তালিকা দেয়ালে শোভা পাচ্ছে আজও।

ডাবের মতোই আঙুর বা আমের জোগানও বন্ধ। ফলে এই দুই শরবতও পাওয়া যাচ্ছে না এখন। অন্যদিকে কৃত্রিম ফ্লেবার ব্যবহার করার বিষয়ে এখনও ‘না’ উত্তর দিয়ে আসছেন পার্থ বাবু। “তিন প্রজন্মের এই দোকানের ঐতিহ্য এই যে এখানে সম্পূর্ণ ফলের রস দিয়ে শরবৎ বানানো হয়। এই ঐতিহ্যের সঙ্গে আপোষ করা সম্ভব নয়।” বলছিলেন পার্থ মজুমদার। কিন্তু এই তিন প্রজন্মের ব্যবসায় এমন অভূতপূর্ব মন্দাও তো দেখা যায়নি কখনও। এমনকি দুর্গাপুজোর সময়েও ব্যবসার তেমন উন্নতি হবে বলে মনে করছেন না তিনি। “আসলে শরবতের বিষয়ে এক ধরনের ভয়ও কাজ করছে মানুষের মধ্যে। যদি এখান থেকেই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে।” যদিও স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্যানিটাইজেশন প্রক্রিয়া যথাযথভাবে পালন করছে প্যারামাউন্ট। 

তবে এই হতাশার মধ্যেও দুঃসময় কাটিয়ে আবার ছন্দে ফেরার বিষয়ে আশাবাদী পার্থ মজুমদার। হয়তো খুব তাড়াতাড়ি সমস্ত আতঙ্ক সরিয়ে রেখে মানুষ আবার আসবে প্যারামাউন্টে। আর ডাবের জোগানের রাস্তাও সহজ হয়ে যাবে ততদিনে। একগ্লাস শরবতে চুমুক দিয়ে আবার ক্রেতারা বলে উঠবেন, ‘আহ্!’

আরও পড়ুন
মান্না দে-র হাতে দায়িত্ব দিয়ে, মুম্বাই ছেড়ে কলকাতায় ফিরতে চেয়েছিলেন শচীন কর্তা!

Powered by Froala Editor

More From Author See More