পুরুলিয়ায় শবরদের জন্য স্কুল গড়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি কলকাতা পুলিশের কনস্টেবলের

আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগের কথা, অরূপ মুখোপাধ্যায় তখন এক বালক। পুরুলিয়ার একটি গ্রামে জন্ম, সেখানেই বেড়ে ওঠা। জ্ঞান হওয়ার পর নিজের বাড়িতে এবং প্রতিবেশিদের বাড়িতেও প্রায়ই চুরি যেত জিনিসপত্র। বড়োরা বলতেন, শবররা চুরি করেছে। অনেক সময় চোরকে হাতেনাতে ধরে উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থাও করা হয়। অরূপ তখন ভাবতেন, শবররা কি শুধু চুরিই করে? কিন্তু কেন? দাদুকে এই নিয়ে প্রশ্ন করতে তিনি বলেন, অভাব আর অশিক্ষাই এর জন্য দায়ী। তার সঙ্গে সামাজিক বৈষম্য আরেক কারণ মানুষকে অপরাধের দিকে ঠেলে দেওয়ার। সেই বালক অবস্থাতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন, বড় হয়ে যখন তিনি চাকরি করবেন তখন শবরদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করবেন।

অরূপ মুখোপাধ্যায়ের সেই স্বপ্ন এখন বাস্তবের রূপ নিয়েছে। পুরুলিয়ার মানবাজার এলাকার পুঞ্চা গ্রামে তিনি তৈরি করেছেন ‘পুঞ্চা নবদিশা মডেল স্কুল’। সেখানে যেসব পড়ুয়া পড়াশুনো করে, তাদের অনেকেরই মা-বাবা চুরির অভিযোগে নানা সময় জেল খেটেছেন। পরিবারে পড়াশুনোর অবকাশ প্রায় কিছু নেই বললেই চলে। আর সেই অন্ধকারেই আলো জ্বালার কাজ করে চলেছে নবদিশা মডেল স্কুল। প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত প্রত্যেক পড়ুয়ার শিক্ষার পাশাপাশি থাকা-খাওয়া এবং জীবনযাপনের যাবতীয় খরচ বহন করে ‘পাঁড়ুই মানবকল্যাণ সমিতি’।

নামেই সমিতি, আসলে বেশিরভাগ খরচটাই আসে অরূপ মুখোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত উপার্জন থেকে। কলকাতা পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের সামান্য একজন কনস্টেবল তিনি। উপার্জন তাঁর খুব বেশি কিছু নয়। কিন্তু তারও বেশিরভাগটাই চলে যায় শবর শিশুদের জীবনে শিক্ষার আলো জ্বালতে। এমনকি স্কুলের পড়াশুনো শেষ করে যখন তারা স্থানীয় হাইস্কুলে ভর্তি হয়, তখনও তাদের পড়াশুনোর খরচ যতটা সম্ভব বহন করেন অরূপ মুখোপাধ্যায়।

১৯৯৬ সালে চাকরিতে যোগ দেন অরূপ মুখোপাধ্যায়। অর্থ সঞ্চয় করেছেন সেদিন থেকেই। তারপর ২০১১ সাল নাগাদ জ্যাঠা ক্ষীরোদ মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে পেয়ে গেলেন ১০ কাঠা জমি। আর তার উপরেই তৈরি হল স্কুল। সঞ্চয় যা ছিল, তার পরেও কিছু টাকার প্রয়োজন। আর তাই ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিলেন মায়ের অসুস্থতার কথা বলে। এমনকি মায়ের কাছেও যা সঞ্চয় ছিল, সেটাও তিনি তুলে দিলেন অরূপবাবুর হাতে। ২০১১ সালে মাত্র ২২ জন পড়ুয়াকে নিয়ে পথচলা শুরু নবদিশা মডেল স্কুলের। আর এখন সেখানে পড়ুয়ার সংখ্যা ১২৬। স্কুল পরিচালনার কাজে যে কোনোরকম সাহায্য পাননি অরূপবাবু, তা কিন্তু নয়। অনেকে ব্যক্তিগত সাহায্য করেছেন, কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাহায্যই পাননি কোনোদিন। তাতে অবশ্য হার মানার পাত্র নন অরূপবাবু। তিনি তো নিজের চেষ্টাতেই এই স্কুল তৈরির কথা ভেবেছিলেন।

দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার ফলে এখন একটু একটু করে বদলেছে গ্রামের পরিবেশ। পুলিশের রেকর্ড বলছে চুরি-ডাকাতির পরিমাণও কমেছে যথেষ্ট পরিমাণে। সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য এই কাজের কোনো স্বীকৃতি পাননি তিনি। কিন্তু অনেক বেসরকারি সংগঠন তাঁকে সম্মান জানিয়েছে। ২০১৭ সালে ব্যাঙ্গালোরের একটি সংস্থার কাছ থেকে পেয়েছেন 'বেস্ট সোশ্যাল ওয়ার্কার অ্যাওয়ার্ড', রাজস্থানের একটি সংস্থা তাঁকে দিয়েছে 'টিচার ওয়ারিয়র অ্যাওয়ার্ড', পেয়েছেন 'টেলিগ্রাফ এডুকেশন অ্যাওয়ার্ড'ও। আর এবার সেই সম্মান এল বিদেশ থেকেও। অরূপ মুখোপাধ্যায়ের নাম উঠল ‘ব্র্যাভো ইন্টারন্যাশনাল বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে’। তবে এই সম্মান পাওয়ার পরেও নির্বিকার অরূপ মুখোপাধ্যায়। এখনও তিনি একইভাবে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করবেন। রাস্তায় হঠাৎ দেখলে কেউ হয়তো চিনতেও পারবেন না, এই মানুষটাই এমন এক বৈপ্লবিক কাজের কাণ্ডারি।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
পরিকাঠামোর অভাবে বন্ধ পড়াশোনা, গবাদি পশু চরাতে হচ্ছে গিরের পড়ুয়াদের

Latest News See More