ক্রমাগত চরিত্র বদলে চলেছে করোনাভাইরাস। আর সেই কারণেই, দ্বিতীয় তরঙ্গে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বহু যুবক-যুবতী, মধ্যবয়সী। প্রাণও হারাতে হয়েছে অনেককেই। কোভিডের প্রকোপে মাতৃহারা হয়েছে বহু সদ্যোজাত— রয়েছে এমন উদাহরণও। ফলত রক্ত, হাসপাতালের শয্যা এবং অক্সিজেনের পাশাপাশি চাহিদা বাড়ছে মাতৃদুগ্ধেরও। নাহলে যে প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হবে না ছোট্ট শিশুগুলিরও। এমন পরিস্থিতিতেই অভিনব উদ্যোগ নিলেন কলকাতার দুই তরুণী।
“দিল্লি, অসম, মুম্বাই-সহ একাধিক জায়গাতেই এই বিষয়টা নিয়ে কাজ হচ্ছে। অনেক সংস্থাই সক্রিয়ভাবে মাতৃদুগ্ধের ব্যাঙ্কও তৈরি করেছে। তবে পশ্চিমবঙ্গে এই কাজটা একেবারেই হচ্ছে না। ফলে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে বহু সদ্যজাতের পরিবার। সেখান থেকেই এই উদ্যোগ। আমরা চেষ্টা করছি দুগ্ধদানে ইচ্ছুক মায়েদের সঙ্গে এই পরিবারগুলির যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার।” বলছিলেন হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তথা গবেষক বৈদেহী দাস।
বৈদেহী এবং টাটা ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্সের ছাত্রী মণিময়ী চক্রবর্তীই এই উদ্যোগের মূল উদ্যোক্তা। মাতৃদুগ্ধদানে ইচ্ছুক মায়েদের তথ্যভাণ্ডার তৈরি তো বটেই, প্রথাগত ট্যাবু ভেঙে যাতে সকলে এগিয়ে আসেন সদ্যজাতদের সাহায্যের জন্য, সেই আবেদন নিয়েই সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। গড়ে তুলতে চাইছেন ব্রেস্ট মিল্ক নেটওয়ার্ক। যাতে মাতৃহারা শিশুর পরিবার সহজেই খুঁজে পেতে পারেন দাতাদের।
আরও পড়ুন
এলগিন ফেয়ারলন এবং কলকাতা 'দ্য সিটি অব জয়'-এর গল্প
ভারতের একাধিক রাজ্যেই রয়েছে সরকারি মাতৃদুগ্ধ ব্যাঙ্ক। তবে পশ্চিমবঙ্গে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতাল ছাড়া আর অন্যকোথাও নেই এই ব্যবস্থা। ফলে শহর ও শহরতলিস সদ্যজাতদের কাছে সেই সুবিধা থাকলেও, সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে প্রান্তিক পরিবারগুলি। জানা গেল, কিছুদিন আগেই এমনই সমস্যায় পড়েছিলেন বাঁকুড়ার একটি পরিবার। সাহায্যের জন্য তাঁদের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল দিল্লির বেশ কিছু দুগ্ধদানে ইচ্ছুক দাতা। শেষ পর্যন্ত জোগাড়ও হয় মাতৃদুগ্ধ। তবে, শিশুর জন্য প্রয়োজন ধারাবাহিকভাবে দুধের যোগান। সেখানেই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দূরত্ব। বর্তমানে স্থানীয় দাতাদের সঙ্গে ওই পরিবারের যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বৈদেহীরা।
আরও পড়ুন
মহামারী পরিস্থিতিতে শঙ্খ ঘোষকে ভার্চুয়াল শ্রদ্ধাজ্ঞাপন কলকাতার শিল্পীসমাজের
ইতিমধ্যেই বেশ ভালোরকমই সাড়া পেয়েছে দুই তরুণীর এই উদ্যোগ। সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছেন অনেকেই। ফলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, আগে থেকেই এই দুধ সংগ্রহ করে কি ব্রেস্ট মিল্ক ব্যাঙ্ক বানানো যায় না? “আসলে মাতৃদুগ্ধ সংরক্ষণের প্রক্রিয়া বেশ জটিল। সেই পরিকাঠামো তৈরি করা সাধ্যের বাইরে। আর সেটার জন্য প্রয়োজন সরকারি অনুমতির। সেই আইনি প্রক্রিয়াও যথেষ্ট জটিল। ফলত সরাসরি ডোনারদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়াই এখন একমাত্র পথ”, উত্তর দিলেন মণিময়ী।
আরও পড়ুন
প্রতিদিন কাশ্মীর থেকে দিল্লিতে পৌঁছচ্ছে মাতৃদুগ্ধ, ৩৫ দিনের শিশুকে বাঁচাতে অক্লান্ত প্রচেষ্টা
কিন্তু খুব সহজ নয় এই কাজটাও। কারণ, এর পরেও রয়েছে অন্যান্য নানান প্রতিবন্ধকতা। আর তার অন্যতম একটি দিক হল পরিবহন। মহামারীর পরিস্থিতিতে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে দুগ্ধ সংগ্রহ কিংবা দান— দুটোই প্রায় অসম্ভব। ফলত গোটা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল ভিত্তিক আলাদা আলাদা তথ্যভাণ্ডার তৈরি করাই লক্ষ্য মণিময়ী-বৈদেহীদের। তার জন্য দরকার আরও বেশি সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবকেরও। ফলত, তরুণ প্রজন্মের কাছে এগিয়ে আসার আবেদনও রাখছেন তাঁরা।
মাতৃদুগ্ধদানের এই উদ্যোগে সদ্যজাত সন্তানদের মায়েদের এগিয়ে আসার আর্জি জানালেন টাকি রুরাল হসপিটালের চিকিৎসক ডাঃ তমোজিৎ গোস্বামীও। তমোজিৎবাবুর কথায়, “অনেকেই আশঙ্কা করেন দুগ্ধদান করলে তাঁদের সন্তান পর্যাপ্ত দুঘ পাবে কিনা তা নিয়ে। তবে একজন মায়ের দেহে যে পরিমাণ দুগ্ধ তৈরি হয়, তা তিনটি শিশুর জন্য পর্যাপ্ত। এই বিষয়টি অনেকের কাছেই পরিষ্কার নয়। তবে দুগ্ধ সংগ্রহের আগে দুগ্ধদাতার বিষয়ে কয়েকটি তথ্য যাচাই করে নেওয়া জরুরি। কোনো মা থাইরয়েড, প্রেসার কিংবা সুগারের দীর্ঘ মেডিকেশনের মধ্যে না থাকলে তবেই তাঁর থেকে দুগ্ধ সংগ্রহ করা উচিত।”
বর্তমানে ইচ্ছুকদের যোগাযোগের জন্য ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে পেজ 'ব্রেস্ট মিল্ক রিসোর্স নেটওয়ার্ক' তৈরি করেছেন এই দুই তরুণী। টেলিফোন ছাড়াও নিয়মিত এই পেজের মাধ্যমেও যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। এই উদ্যোগের গুরুত্ব ঠিক কতটা তা নতুন করে বলার কিছুই নয়। বাজার চলতি বেবিফুড বা প্রক্রিয়াজাত দুধ যে মাতৃদুগ্ধের বিকল্প হতে পারে না কোনোভাবেই। সেই জায়গাতে দাঁড়িয়ে সদ্যজাতদের বেঁচে থাকার অধিকারের পক্ষেই যেন সরব হয়েছেন তাঁরা…
Powered by Froala Editor