লেখকের পরিচয় গোপন, উপন্যাসের নামেই নামকরণ কলকাতার রাস্তার

ম্যাডক্স স্কয়ারের পাশে হাজরা রোডের গা ঘেঁষে ছোট্ট একটা রাস্তা। নাম স্বর্ণলতা স্ট্রিট (Swarnalata Street)। স্বর্ণলতা, নামটা শুনলে প্রথমেই মনে হতে পারে কোনো নারীর নাম। হ্যাঁ, স্বর্ণলতা গাছের কথাও মনে হতে পারে। কিন্তু মানুষের নামে রাস্তার নামকরণ হওয়ার সম্ভাবনাই থাকে বেশি। কিন্তু কে এই স্বর্ণলতা? আশেপাশের ইতিহাস খোঁজ করলে এই নামের কারোর কথা জানা যায় না। তবে এই ভবানীপুর অঞ্চলেই থাকতেন লেখক তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (Taraknath Gangopadhyay)। হ্যাঁ, তাঁর নামের সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা সকলেই জানেন ‘স্বর্ণলতা’ লেখকের প্রথম উপন্যাসের নাম। আর এই রাস্তা? সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম এমন কোনো রাস্তা, যার নামকরণ হয়েছে একটি উপন্যাসের নামে।

তখন বাংলার সাহিত্যের আকাশে বঙ্কিম সূর্য জ্বলছে। বলা ভালো, বাঙালিকে উপন্যাস পড়তে এবং বাংলার সাহিত্যিকদের উপন্যাস লিখতে শেখাচ্ছেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু তাঁর রোমান্সধর্মী উপন্যাস যে সবাই সাদরে গ্রহণ করেছিলেন, এমন নয়। তুলনায় ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তবে সামাজিক উপন্যাস লেখার তাগিদ অনুভব করেননি বঙ্কিমচন্দ্র। ঠিক এই সময় ১৮৭২-৭৩ সালে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ পত্রিকায় প্রকাশ পেতে শুরু করল নতুন একটি উপন্যাস। নাম ‘স্বর্ণলতা’। পত্রিকায় প্রকাশের সময় থেকেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেল উপন্যাসটি। এমনকি পরের বছর, অর্থাৎ ১৮৭৪ সালে সেটা বই আকারেও প্রকাশ পেল। কিন্তু তারপরেও একটি প্রশ্নের উত্তর অজানাই থেকে গেল। উপন্যাসের লেখকের নাম।

কলেজ স্ট্রিটের ‘ক্যানিং লাইব্রেরী’ থেকে প্রকাশিত বইতে শুধু লেখা ছিল ‘শ্রী যোগেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক প্রকাশিত’। তাতে অবশ্য বই বিক্রি আটকায়নি। ৯ বছরের মধ্যে বইটির তিনটি সংস্করণ শেষ হয়ে যায়। এদিকে পাঠকদের মধ্যে শুরু হয়ে যায় নানা জল্পনা। পরিস্থিতি এমন হয়ে ওঠে, সাময়িক পত্রিকায় অনেক লেখক নিজেদের ‘স্বর্ণলতা’-র লেখক বলে দাবিও করতে থাকেন। অবশ্য বেশিরভাগ পাঠক মনে করেছিলেন, খোদ সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রই বুঝি আড়ালে থেকে সম্পূর্ণ নতুন ভাষায় নতুন বিষয়বস্তু নিয়ে একটি উপন্যাস লিখেছেন। আর এই সমস্ত জল্পনার মধ্যে অধৈর্য হয়ে উঠেছিলেন বইয়ের প্রকাশক যোগেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সাহিত্যিক ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁরা দুজনেই কেবল জানতেন লেখকের আসল পরিচয়।

আরও পড়ুন
উপন্যাসের জন্য চাকরি খুইয়েছেন অজিত রায়, হতে হয়েছে ঘরছাড়াও

প্রকাশকের অনুরোধ বারবার ফিরিয়ে দিয়েছেন লেখক। কিন্তু চতুর্থ সংস্করণ প্রকাশের আগে ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় রীতিমতো জোর করলেন লেখককে। ফলে এবার তাঁকে প্রকাশ্যে আসতেই হল। ১৮৮৩ সালে প্রকাশিত চতুর্থ সংস্করণে দেখা গেল ঔপন্যাসিকের নাম তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। পেশায় চিকিৎসক। থাকেন ভবাণীপুর অঞ্চলের একটি বাড়িতে। নিজের শখেই সাহিত্যচর্চা করেন। তবে বই প্রকাশের ইচ্ছা তাঁর তেমন ছিল না। কেবল বঙ্কিমচন্দ্রের রোমান্সধর্মী উপন্যাসের বাইরেও যে উপন্যাসের নানা সম্ভাবনা রয়েছে, সেটা প্রমাণ করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। আর সেই উদ্দেশ্যেই ‘স্বর্ণলতা’ উপন্যাসটি প্রকাশ করেছিলেন তিনি।

আরও পড়ুন
বুকারে প্রত্যাখ্যাত উপন্যাসেই নোবেলপ্রাপ্তি; ‘অচেনা’ গুরনাহ্‌ ও উদ্বাস্তুকথন

জনপ্রিয়তার চাপে এরপর আরও ৪টি উপন্যাস রচনা করেছিলেন তারকনাথ। 'ললিত সৌদামিনী', 'হরিষে বিষাদ', 'তিনটি গল্প' এবং 'অদৃষ্ট'। অবশ্য এগুলি কোনোটাই ‘স্বর্ণলতা’-র মতো জনপ্রিয় হল না। এমনকি সাহিত্যের জগতেও খুব বড়ো আসন পেলেন না তারকনাথ। সুকুমার সেন ‘স্বর্ণলতা’ সম্বন্ধে লিখেছিলেন, “বঙ্কিমের ভাষাসৌভাগ্য তারকনাথের ছিল না। তবে বঙ্কিমের রচনার মতো সরসতা এবং কাব্যশ্রী না থাকিলেও স্বর্ণলতার ভাষা সরল, প্রাঞ্জল এবং বর্ণনীয় বিষয়ের বিশেষ উপযোগী। ভাষার আভরণহীনতা বিষয়বস্তুর পক্ষে নিরতিশয় শোভন হইয়াছে।” এই ভাষা সারল্যই তাঁকে ব্যতিক্রমী করে রেখেছে। সমকালের চেয়ে এখানেই এগিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

আরও পড়ুন
চারজনকে খুনের পর নিজেই উপন্যাস লিখে ‘ক্লু’ দিয়েছিলেন এই হত্যাকারী!

তবে এই সমস্ত আলোচনার চেয়েও বড়ো কথা, উপন্যাসটির জনপ্রিয়তা। উনিশ শতকে সারা পৃথিবীর কেউ ভাবতেই পারতেন না, একটি উপন্যাসের নামে রাস্তার নামকরণ হতে পারে। ঠিক কোন সময়ে রাস্তার নাম ‘স্বর্ণলতা স্ট্রিট’ রাখা হয়, তা অবশ্য জানা যায় না। তবে সেটা বিশ শতকের আগেই। হয়তো লেখকের নাম জানার আগেই রাস্তার নামকরণ হয়েছিল উপন্যাসের নামে। এরপর বাংলা ভাষার আরও একটি বইয়ের নামে কলকাতায় আরেকটি রাস্তার নাম রাখা হয়। ‘বিশ্বকোষ লেন’। বর্তমানে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশেও বইয়ের নামে রাস্তার নামকরণের রেওয়াজ শুরু হয়েছে। তবে এর বহু আগে পথ দেখিয়েছিল বাংলাই।

তথ্যসূত্রঃ
১. বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, দ্বিতীয় খণ্ড, সুকুমার সেন
২. লেখক নয়, উপন্যাসের নামে হয়েছিল কলকাতার রাস্তার নাম, উজ্জ্বল কুমার মুখার্জী, পেজফোর

Powered by Froala Editor

More From Author See More