পুলিশদের নিয়ে আমাদের কতই না অভাব অভিযোগ। কখনও তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম, সাহস আমাদের মুগ্ধ করে, আমাদের আচ্ছন্ন করে; আবার তাঁরাই কখনও কখনও হয়ে যান ভিলেন। তবুও প্রতি বছর একদল যুবক স্বপ্ন দেখেন ওই খাকি অথবা সাদা পোশাক পরার। এক ব্যাচ যখন ঢোকে ক্যাম্পে, অন্যদিকে আরেক ব্যাচ বেরিয়ে যায়। পুরনো-নতুনের এমন মিলনেই বেঁচে আছে কলকাতা, বেঁচে আছে বাংলা; বেঁচে আছে পুলিশ।
অনেকেরই নিজের নিজের জীবনে রোল মডেল রয়েছে। পুলিশেরও কি তাই? জিজ্ঞেস করলে উত্তরও হয়তো মিলবে। কিন্তু কোনো পুলিশ অফিসারই যদি হাজার হাজার লোকের রোল মডেল হন? একটা সময় কল্লোলিনী তিলোত্তমার বুকে এরকমই একজন অফিসার ছিলেন; যার নাম প্রতিটা মানুষ সম্ভ্রমের সঙ্গে উচ্চারণ করত। কাজের প্রতি নিষ্ঠা, পরিশ্রম ও ব্যক্তিত্বই তাঁকে করে তুলেছিল কিংবদন্তি। হয়ে উঠেছিলেন ‘দ্য ওয়ান অ্যান্ড অনলি’ রনি মুর।
রনি মুর বিদেশি নন, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। এই দেশেই জন্মেছেন, এখানেই বেড়ে উঠেছেন। ১৯২০ সালে জন্মেছিলেন; বেঁচে থাকলে এই বছরটা তাঁর জন্মের শতবর্ষ হিসেবে পালন করত দেশ। ছোটো থেকেই স্বপ্ন দেখতেন অ্যাডভেঞ্চারের। জীবনটা যেন একটা ঘোড়দৌড়ের মতো হয়, যেন বক্সিং রিং। প্রতিটা মার, প্রতিটা ধুলো খাওয়া যেন আগামীটাকে আরও স্পষ্ট করে, শক্ত করে। সেই অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় ঢুকে পড়া পুলিশে।
প্রথম কাজ অবশ্য ছিল ফায়ারম্যানের। তারপর সেখান থেকে তরতরিয়ে এগিয়ে গেছেন রনি মুর। স্রেফ নিজের কর্মদক্ষতার জোরেই তা সম্ভব হয়েছে। সামান্য ফায়ারম্যান থেকে সার্জেন্ট, সার্জেন্ট মেজর, ইন্সপেক্টর, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার থেকে কলকাতা আর্মড পুলিশের ডেপুটি কমিশনার— যেন স্বপ্নের এক যাত্রা। যার প্রতিটি পরতে পরতে মিশেছিল এক অদম্য সাহসী যুবকের লড়ে জায়গা করে নেওয়ার গল্প।
পুলিশ হিসেবে রনি মুর স্মরণীয় হয়ে থাকবেন দাঙ্গা দমনের জন্য। সালটা ১৯৪৬। কলকাতা দেখছে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের মুহূর্ত। দুই ধর্মের মানুষের রক্তে কালো হয়ে গেল শহর। চারিদিকে আতঙ্ক। একজন পুলিশের পক্ষে এমন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা বিশেষ দক্ষতার কাজ। একটু এদিক থেকে ওদিক হলে আগুন আরও বাড়বে। সেই কাজটাই প্রায় একার হাতে করেছিলেন রনি মুর। বন্দুক, গোলা-বারুদ কিচ্ছু নয়; স্রেফ লাঠির জোরে জয় করেছিলেন সেই কঠিন মুহূর্তকে। সবাই অবাক হয়ে দেখেছিল এক তরুণের বীরত্বের। ঠান্ডা মাথায় কীভাবে এমন কাজ হাসিল করতে হয়, রনি মুর ছাড়া আর কেউ জানে!
খানিক আগেই রনি’র সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে দুটো শব্দ চলে এসেছিল। ঘোড়দৌড়, এবং বক্সিং রিং। এই দুইয়ের সঙ্গেই অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল রনি মুরের। প্রায় জোর করে, নিজের চেষ্টায় ঘোড়ায় চড়া শিখেছিলেন। সেই ঘোড়ায় চেপেই চলত তাঁর শাসন। জীবনটাও তো ট্র্যাক, তিনি হচ্ছেন ঘোড়া। দৌড়েই গেছেন। ঠিক যেমন বেছে নিয়েছিলেন বক্সিংকে। ছোটো থেকেই বক্সিং তাঁর কাছে প্রেম ছিল। রনি মুরের নিজেরও বেশ শক্তিশালী চেহারা ছিল। পুলিশে যোগ দিয়েও বক্সিং ছাড়েননি। কলকাতায় থেকেই একের পর এক খেতাব জিতেছেন তিনি। অধিকাংশ সময়ই জিততেন। রনি মুর তখন কলকাতাবাসীর কাছে একজন জলজ্যান্ত স্টার, কিংবদন্তি। ১৯৫২ এবং ১৯৫৭— বক্সিংয়ে দুবারের ভারতসেরা ছিলেন তিনি। ডাক পেয়েছিলেন অলিম্পিকেও। একজন খেলোয়াড়ের পক্ষে এর থেকে বড়ো মঞ্চ আর কী হতে পারে। কিন্তু সেই ডাকও হেলায় ছেড়ে দিয়েছিলেন রনি মুর! সবাই অবাক হয়ে তাকিয়েছিল মানুষটির দিকে। কাজে ব্যাঘাত ঘটবে, কলকাতা ছেড়ে দূরে চলে যেতে হবে, তাই আর গেলেন না অলিম্পিকে। আমরা কলকাতায় জন্মেও এমনভাবে ভালবাসতে পেরেছি শহরটাকে?
আরও পড়ুন
ব্যাডমিন্টনে বিশ্ব র্যাঙ্কিং ৪, আমরা কি মনে রেখেছি মনোজ গুহ-কে?
এহেন এক চরিত্র যখন অবসর নেন, তখন সবার কী অবস্থা হয়, এক কথায় বলা সম্ভব নয়। মনে করুন শচিন তেন্ডুলকরের অবসর ঘোষণার সেই মুহূর্ত। ভগবানও কাঁদছেন, ভক্তও কাঁদছেন। লালবাজারের লাল বাড়ির কাছে রনি মুর ছিলেন সেই কিংবদন্তি। রোনার্ল্ড অ্যালেন মুর আর কেউ মনে রাখেনি, রনি মুরই অমর হয়ে থেকে গেছেন। ২০১৩ সালে সুদূর অস্ট্রেলিয়ার পারথে যখন ৯৩ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস নিলেন রনি মুর; কয়েকশো কিমি দূরের কলকাতাও কেঁদেছিল। এমন মানুষই বোধহয় ‘মিথ’ হয়ে থেকে যান।
Powered by Froala Editor