ভাষা থেকে ভাষাহীনতায় কবিতাযাত্রা, সাক্ষী রইল কলকাতা

কবিতা, কবিতাপাঠের অনুষ্ঠান, কবি সম্মেলন – এই সবকিছুই কলকাতা শহর আগেও দেখেছে। এই শহরে বিশ্বের নানা প্রান্তের কবিদের যাতায়াতও নতুন নয়। তবে কবিতার ভাষা হয়তো সবসময়ই একটা বাধা হয়ে থেকে গিয়েছে। অথচ কবিতাকে কি ভাষার আঞ্চলিকতায় বেঁধে ফেলা যায়? নাকি কবিতা মানে শুধুই কবির খাতায় অথবা ছাপার হরফে বন্দি কিছু অজড় অক্ষর? এই প্রশ্নকে সামনে রেখেই তিনদিন ধরে এক ব্যতিক্রমী আয়োজনের সাক্ষী থাকল কলকাতা শহর। সল্টলেক ইজেডসিসি সভাগৃহে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল কলকাতা পোয়েট্রি কনফ্লুয়েন্স।

কনফ্লুয়েন্স, অর্থাৎ দুই বা ততোধিক ধারার মিলনবিন্দু। এই ধারা যেমন নানা ভাষার ধারা, তেমনই ভাষার চেয়ে অধিক নানাকিছুরও। অনুষ্ঠানের শুরুতেই মঞ্চে নাটক পরিবেশন করলেন ‘আরঞ্জক’ গোষ্ঠীর বিশেষভাবে সক্ষম শিশুরা। শুধু উপাস্থাপনার শৈলীতেই তো নয়, তার ভাষাও শব্দের চেয়ে আরও বৃহৎ কোনো স্বতন্ত্রতার ইঙ্গিত দিয়ে যায়। এই অনুষ্ঠানের আয়োজক ‘ভাষা সংসদ’ এবং ‘অ্যান্টোনিম’ পত্রিকার সদস্যরা মনে করেন, সেটাও তো কবিতার ভাষাই। সেই অনুরণন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন মালায়ালি ভাষার কবি কে সচ্চিদানন্দন তাঁর নিজের আঞ্চলিক ভাষার জাদুতে মুগ্ধ করে রাখেন বাঙালি শ্রোতাদের। অথবা দ্বিতীয় দিনে কলোম্বিয়ার কবি ইকারো ভালদেরামা মঞ্চে ওঠেন ‘অন্যদেশ’ গোষ্ঠীর দৃষ্টিহীন শিল্পীদের নিয়ে। আপাত ভাষাহীন এক শৈলী ‘কোতোদামা’ পরিবেশন করেন ভালদেরামা এবং তাঁর নতুন বন্ধুরা। ‘কোতোদামা’ – যার বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় ভাষার আত্মা। ভালদেরামার কথায়, এই ভাষা প্রকৃতির ভাষা। যা থেকে মানুষের সমস্ত ভাষারও জন্ম। মিনিট কুড়ির স্বরক্ষেপনে তাঁরা ক্রমশ যেন তৃণভূমি পেরিয়ে, ঘন অরণ্য পেরিয়ে পৌঁছে যান এক পাহাড়ি ঝর্ণার দিকে।

আয়োজকরা অবশ্য বলেছিলেন, এই আসর অনুবাদ কবিতার আসর। তবে সেই অনুবাদ যে শুধুই এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় অনুবাদ নয়, বরং ক্রমশ ভাষা থেকে ভাষাহীনতার অভিমুখে যাত্রা, তাও স্পষ্ট হয়ে যায় অনুষ্ঠানের চলনেই। আলোচনা হয় অনুবাদের নিজস্ব রাজনীতি নিয়েও। এমনকি ভাষার মধ্যে থাকা নিপীড়নের প্রসঙ্গও এসে পড়ে। ‘ক্যালকাটা কারোয়াঁ’-র শিল্পীরা মঞ্চে হাজির হন এক অভিনব আয়োজন নিয়ে। সুরে-কথায় সংস্কৃত সাহিত্যের প্রাচীনতম শ্লোক থেকে ক্রমশ ভাষার বিবর্তনকেই যেন মূর্ত করে তোলেন তাঁরা। এই দিনই উপস্থিত ছিলেন অপর্ণা সেন এবং কল্যাণ রায়। তাঁদের কথায় উঠে আসে অনুবাদ সাহিত্যের নানা প্রতিকূলতার প্রসঙ্গও। ভাষা তো এক অর্থে সংস্কৃতিকেও ধারণ করে। কবিতার ভাষান্তর আসলে এক সংস্কৃতির সঙ্গে আরেক সংস্কৃতিকেও জুড়ে দেয়। বাংলাদেশের কবি মহম্মদ নুরুল হুদা তাই বলেন, একসময় তিনি অনুবাদকে কবিতার মৃত্যু মনে করতেন। কিন্তু এখন তিনি সেই মত বদলেছেন। এমনকি নিজেও নিজের কবিতা বা অন্য কবির কবিতা অনুবাদের চেষ্টা করতে থাকেন নিরন্তর। তাঁর কথায়, অনুবাদ আসলে কবিতার পুণর্জন্ম ঘটায়।

আবার কবিতাকে আশ্রয় করে যখন গান জন্ম নেয়, সেও তো এক ভাষান্তর। কলকাতা পোয়েট্রি কনফ্লুয়েন্সের আসর ছুঁয়ে যায় সেই প্রসঙ্গও। দক্ষিণ ভারতের একসময়ের জনপ্রিয় লোকগীতির ধারা ‘গুজিলি’-কে নতুন করে ফিরিয়ে আনেন মোনালি বালাসুব্রহ্মনিয়ম, নিবেদিতা লুইস এবং এম দীপন। গানের সুরে এবং সহজ কথার চলনে ঔপনিবেশিক সময়ে ‘গুজিলি’-ই হয়ে উঠেছিল লোকশিক্ষার অন্যতম মাধ্যম। মারাঠি কবি সন্তোষ পাওয়ারের কথাতেও উঠে আসে কবিতার নিজস্ব সুরের প্রসঙ্গ। আবার তারই মধ্যে বাঙালি কবি শ্রীজাতর একগুচ্ছ কবিতায় সুরারোপ করে পরিবেশন করেন কলকাতার তরুণ-তরুণীরা। মঞ্চে কবির কণ্ঠে কবিতাপাঠ, আবার তারই সঙ্গে সুরারোপের ভিতর দিয়ে যেন এক আলেক্ষ রচনার কাজ চলছিল তখন।


শেষদিনের অনুষ্ঠান শুরু হয় বাচিকশিল্পী শোভনসুন্দর বসুর সঙ্গে মনোবিদ দেবাঞ্জন পানের আলোচনা দিয়ে। মনঃস্তাত্ত্বিক চিকিৎসায় পাশ্চাত্যের নানা দেশে কবিতার ব্যবহার হয়ে আসছে গত প্রায় ৫ দশক জুড়ে। আমাদের দেশে সেই চিকিৎসার সম্ভাবনার লক্ষণগুলো নিয়েই আলোচনা করলেন দেবাঞ্জন। পরবর্তী আলোচনাগুলিতে উঠে এল কবিতার আঞ্চলিকতা, দেহ রাজনীতি, নারীর অধিকারের প্রসঙ্গও। শুভ মৈত্রের সঙ্গে কথোপকথনে ভালদেরামা জানান, তিনি আদৌ জানেন না শ্রোতারা তাঁকে কবি হিসাবে গ্রহণ করেন, নাকি গায়ক না অন্য কিছু। তবে তিনি নিজেকে মনেপ্রাণে কবিই মনে করেন। অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় ও সুদেষ্ণা রায়ের আলোচনা অনুবাদ সম্পর্কে ধারণাকে আরও বিস্তৃত করে তোলে। সুদেষ্ণা রায় বলেন, বিভিন্ন সিনেমার বা অনুষ্ঠানের বা গানের যে শিরোলিপি লেখা হয়, তাও তো অনুবাদই। বরং সেখানে আরও স্বল্প পরিসরে অনুবাদ সাহিত্যের সমস্ত সম্ভাবনাকে বেঁধে রাখতে হয়।

অনুষ্ঠানের একেবারে শেষ লগ্নে এসে পরপর তিনটি উপাস্থাপনা যেন বিষয়ের বিস্তারকে আরও বাড়িয়ে দেয়। ইংরেজি সাহিত্যের কবি ‘অঞ্জু মাখিজা’-র কাব্যনাট্য ‘মিটিং উইথ যামা’-র সঙ্গে সঙ্গেই উপস্থাপিত হয় ইতালির কবি মিয়া লেকোঁ-র কাব্যিক উপস্থাপনা ‘আ হোম আউটসাইড’। আর সবশেষে ‘শঙ্খমালা’ গোষ্ঠীর সদস্যরা কথায়, সুরে তুলে ধরলেন কলকাতা শহরের সাড়ে তিনশো বছরের ইতিহাসকে।

তিনদিনের এই অনুষ্ঠান তবু যেন এখানেই শেষ হওয়ার নয়। এও তো আসলে এক যাত্রা। কবিতার অভিমুখে অথবা কবিতাকে সঙ্গী করে – বেঁচে থাকার যাত্রা। যে যাত্রায় এসে বলতে হয়, ‘শুধু কবিতার জন্য, আরো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে লোভ হয়’।

Powered by Froala Editor

Latest News See More