অনুবাদ কবিতার মহোৎসব, ঐতিহাসিক ‘পোয়েট্রি কনফ্লুয়েন্স’-এর সাক্ষী হতে চলেছে কলকাতা

কলকাতার সঙ্গে কবিতার সম্পর্ক চিরন্তন। তবে শুধু বাংলা নয়, কলকাতা হয়ে উঠছে একাধিক ভাষাভাষি কবিতার মিলনক্ষেত্র। আগামী ১০-১২ জুন কলকাতার বুকেই আয়োজিত হচ্ছে ‘কলকাতা পোয়েট্রি কনফ্লুয়েন্স’ (Kolkata Poetry Confluence)। কবিতার ভাষান্তর, রূপান্তর, অনুবাদ নিয়েই এত বড়ো আন্তর্জাতিক মানের সম্মেলন কলকাতায় এই প্রথম। সেদিক থেকে দেখতে গেলে, এই সম্মেলনকে অনুবাদ কবিতার মহোৎসব বললেও ভুল হয় না এতটুকু।

“কবিতা লিখলেই দায় ফুরিয়ে যায় না কবির। সেটা বৈশ্বিক পাঠকের কাছে পৌঁছানো এবং ভাষান্তর হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। আমরা এমন একটা প্ল্যাটফর্ম করতে চেয়েছিলাম, যেখানে বাংলার পাঠকরা বিভিন্ন ভাষার কবিতা বাংলা ও ইংরাজি ভাষায় শুনতে পারবেন এবং সেই প্ল্যাটফর্ম এখানকার কবিদের সঙ্গে অন্যান্য ভাষাভাষী কবিদের যোগাসূত্র হয়ে উঠবে”, বলছিলেন ‘ভাষা সংসদ’ প্রকাশনার সম্পাদিকা বিতস্তা ঘোষাল। 

‘ভাষা সংসদ’ এবং ‘দ্য অ্যান্টোনিম’ পত্রিকাই এই আন্তর্জাতিক অনুবাদ কবিতার উৎসবের উদ্যোক্তা। বিগত কয়েক দশক ধরেই এই দুই সংস্থা ধারাবাহিকভাবে লালন করে আসছে অনুবাদ সাহিত্যকে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সাহিত্যকে বাংলা এবং ইংরাজির মাধ্যমে পৌঁছে দিচ্ছে বাংলার পাঠকদের ঘরে। এবার ‘ভাষা সংসদ’ ও ‘দ্য অ্যান্টোনিম’-এর যৌথ উদ্যোগে সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিজ্ঞতা পেতে চলেছেন বাংলার পাঠকরা। 

জুন মাসে ইজেডসিসিতে আয়োজিত এই উৎসবে শুধু বিভিন্ন ভাষাভাষীর কবিদের কবিতা পাঠই নয়, বরং উদযাপিত হবে কবিতার একাধিক আঙ্গিক। গানে, অভিনয়ে, যন্ত্রসঙ্গীতে এবং বাচিক শিল্পে চলবে কবিতার অনুসন্ধান। “বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সংস্কৃতি আছে। কবিতা পাঠ বলতে আমরা যা বুঝি, তেমন পাঠ নয়, ভারতের বাইরে বিভিন্ন দেশের কবিরা নিজেদের কবিতাকে গান, বাচিকশিল্প, নাটকের মাধ্যমে নানাভাবে উপস্থাপন করে থাকেন”, জানালেন ‘দ্য অ্যান্টোনিম’-এর কর্ণধার বিশ্বদীপ চক্রবর্তী। জানা গেল, এইসব সাংস্কৃতিক ধারাকে অপরিবর্তিতভাবে বাংলার পাঠকদের সামনে তুলে ধরতেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে তিন মহাদেশের তিন কবি-উপস্থাপককে। ‘কলকাতা পোয়েট্রি কনফ্লুয়েন্স’-এ হাজির থাকবেন লুগান্ডার হাওয়া নাঞ্জোবে, কলম্বিয়ার ইকারো ভালদেরামা এবং ইতালির মিয়া লেকম। তাঁদের কবিতা উপস্থানার সঙ্গে প্রকাশিত হবে তাঁদের অনুবাদ গ্রন্থও। তাছাড়াও এই অনুষ্ঠানে হাজির থাকবেন অপর্ণা সেন, যশোধরা রায়চৌধুরী, শ্রীজাত, অভিজিৎ গুহ, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, কে সচ্চিদানন্দন, সুকির্থারানি, সন্তোষ পাওয়ার, কমল ভোরা, অনামিকা, মুনাব্বর রানা, নাসিম শাফায়ে, সমীর তাঁতি, সরোজ বল, সুদেষ্ণা রায়, মুহাম্মদ নুরুল হুদা, রণজিৎ দাসের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা।

আরও পড়ুন
কলকাতার স্কটিশ গোরস্থান ও ভুলে-যাওয়া নাগরিকদের গল্প

তবে শুধু কবিদেরই নেয়, পাঠক মহলকেও এই সামগ্রিক মিলনোৎসবের অংশ করে নিতে চেয়েছে দুই সংস্থাই। সাধারণের জন্য অনুবাদ কবিতার প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন ‘কলকাতা পোয়েট্রি কনফ্লুয়েন্স’। বেছে নেওয়া হয়েছিল ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের দশটি ভাষার দশ জন কবিকে। বাংলা ও ইংরাজি— দুই ভাষাতেই তাঁদের কবিতা অনুবাদ করার সুযোগ পেয়েছিলেন পাঠকরা। কয়েকটি ভাষার ক্ষেত্রে বাংলা অনুবাদক পাওয়া না গেলেও, সার্বিকভাবে সফল হয়েছে এই প্রতিযোগিতা। প্রশ্ন থেকে যায়, এই প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে কেবলমাত্র ১০টি ভাষাকেই প্রধান্য দেওয়া হল কেন? বিতস্তার ভাষায়, “২৬টি ভাষাকে একসঙ্গে ধরা তো সম্ভব হয় না। আমরা চেষ্টা করেছিলাম উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম মিলিয়ে ভারতের সমস্ত মানচিত্রটিকেই যদি ধরা যায়। যেভাবেই কবিতার গ্রাফটা তৈরি করেছি আমরা।” জানা গেল পূর্ব ভারত থেকে যেমন বাংলার পাশাপাশি নির্বাচিত হয়েছে অসমীয়া এবং ওড়িয়া, তেমনই রয়েছে উত্তরের কাশ্মীরি, হিন্দি এবং উর্দু। দক্ষিণের মালায়লম, তামিল এবং পশ্চিমের মারাঠি ও গুজরাটি ভাষাকেও জায়গা করে দেওয়া হয়েছিল অনুবাদ প্রতিযোগিতায়। বিশ্বদীপ জানালেন, “এর পাশাপাশি ভারত জুড়ে বহু ভাষা আছে, সেগুলিও সমান শক্তিশালী। তবে প্রতিটা ভাষা নিয়ে এই প্রতিযোগিতা করা অসম্ভব। কারণ, এত অনুবাদের বিশ্লেষণ ও বিচার করাটাও বেশ জটিল প্রক্রিয়া। আশা আছে, পরবর্তী সময়ে অন্যান্য ভাষাগুলিকেও আমরা মর্যাদা দেওয়া চেষ্টা করব।”

আরও পড়ুন
১৯ মে-র বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন নিয়ে স্বতন্ত্র পত্রিকা, প্রকাশ কলকাতা থেকেই

পাঠ, অনুবাদ এবং উপস্থাপনা মিলিয়ে কলকাতার বুকে যেন নতুন বসন্ত আনতে চলেছে তিনদিনের এই উৎসব। তাও এই সমস্ত আয়োজন কেবলমাত্র কবিতাকে ঘিরে। সবমিলিয়ে এমন আয়োজন সকল কবিতাপ্রেমীদের কাছে শিহরন জাগানোর মতোই…

আরও পড়ুন
কবিপক্ষের কলকাতা ও একটি সঙ্গীতসন্ধ্যা

Powered by Froala Editor