মেঝেতে মাদুর বিছানো। তার ওপরেই বসে রয়েছে গুটিকয়েক কিশোরী। কেউ সদ্য দশম শ্রেণির পরীক্ষায় পাশ করেছে, কেউ দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়া, কারোর আবার স্কুলের গণ্ডিতে পা রাখা হয়নি কোনোদিন। সামনে খোলা ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাদের পাঠ দিচ্ছেন এক স্বল্পবয়সী তরুণী। হ্যাঁ, এই ছোট্ট ঘরই একটি ক্লাসরুম। তবে প্রথাগত টিউশন কিংবা কোচিং সেন্টার ভাবলে ভুল হবে খানিক। বরং, কিশোর কিশোরীদের বিভিন্ন ধরনের স্কিল ডেভেলপমেন্ট, পার্সোনাল ডেভেলপমেন্ট এবং হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এই ছোট্ট ঘরে।
হাওড়ার নবান্নের ঠিক পাশে অবস্থিত এই ছোট্ট কোচিং সেন্টারের সঙ্গে অন্যান্য প্রশিক্ষণকেন্দ্রের পার্থক্য একটা জায়গাতেই। আর তা হল, এখানকার সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীরাই বাস করে দারিদ্র সীমার নিচে। আর্থিক অনটনের সঙ্গে তাদের লড়াই করতে হয় নিত্যদিন। তাদের ভবিষ্যৎ-ও যেন নির্ধারণ করে দিয়েছে উন্নয়নশীল সমাজ। বড়ো হয়ে বাবা-মায়ের মতোই হাড়ভাঙা খাটুনি যেন তাদের ভবিতব্য। এই টালবাহানার দুনিয়া থেকে বার করে এনে তাদের দিনবদলের স্বপ্ন দেখাচ্ছে হাওড়ার এই প্রশিক্ষণকেন্দ্র। যার নেপথ্যে রয়েছে কলকাতার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা (NGO) ‘লক্ষ্য’ (Lakshya)।
“অর্থের অভাবে শিক্ষা পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে অধিকাংশ দরিদ্র শিশুই স্বপ্ন দেখার সুযোগ পায় না। এই লড়াই চলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। বড়ো হলে পারিবারিক ব্যবসা কিংবা বাবা-মায়ের স্বল্প বেতনের কর্মক্ষেত্রকে বেছে নিতে বাধ্য হতে হয় তারা। এইসব শিশু এবং মহিলারা স্বনির্ভর করে তোলাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য”, বলছিলেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘লক্ষ্য’-র ম্যানেজিং ট্রাস্টি দাউদ সূবাশাহ।
আরও পড়ুন
ধুঁকছে মেদিনীপুরের পালাগান, দুঃস্থ শিল্পীদের পাশে স্বেচ্ছাসেবীরা
আজ থেকে বছর দুয়েক আগের কথা। ২০১৯ সালের শেষের দিক সেটা। কলকাতার কয়েকজন তরুণ-তরুণীর হাত ধরেই শুরু হয়েছিল ‘লক্ষ্য’-র পথ চলা। সেই দলে দাউদ ছাড়াও ছিলেন প্রিয়াঙ্কা বসাক, অনুষ্কা ঘোষ। পাশে দাঁড়িয়েছিলেন জনৈক ব্যক্তি সোয়েব সূবাশাহ। কিন্তু হঠাৎ এমন বিরূপ পরিকল্পনার কারণ কী? “বেশিরভাগ এনজিও-ই ত্রাণ এবং রেশন প্রদানের পথে হাঁটেন। কিন্তু সেভাবে সাহায্য পৌঁছে দেওয়া গেলেও, তা দিয়ে কি আদৌ দারিদ্র দূরীকরণ সম্ভব?”, প্রশ্ন তুললেন দাউদ। তার আগে তাঁরা নিজেরাও যে কাজ করেছেন বিভিন্ন এনজিও-র স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে। বাস্তব পরিস্থিতিকে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন সামনে থেকেই। তাই প্রথাগত স্বেচ্ছাসেবকের তকমা গা থেকে ঝেড়ে ফেলে দুঃস্থ শিশুদের ভবিষ্যৎ গড়ার ‘লক্ষ্যমাত্রা’ স্থির করেছিলেন দাউদরা। কয়েকদিনের মধ্যেই ছোট্ট ক্লাসরুমের বন্দোবস্তও করে ফেলেন হাওড়ার নবান্ন ভবনের পাশে। তারপর শুরু হয় পাঠদানের প্রকল্প। ‘শিক্ষক’-র ভূমিকায় এগিয়ে আসেন কলকাতারই বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী। তাঁরা কেউ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া, কেউ আবার চাকুরিজীবী।
আরও পড়ুন
অযোধ্যা জুড়ে সাফাই অভিযান, দুশো বস্তা আবর্জনা সরালেন স্বেচ্ছাসেবকরা
আরও পড়ুন
দেশজুড়ে লিঙ্গ-হিংসার আবহ, প্রতিবাদে রাজ্যব্যাপী আন্দোলনের ডাক একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার
নাচ, গান, সেলাই, হস্তশিল্প, সাধারণ কম্পিউটার প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে গ্রাফিক্স ডিজাইন এবং ব্লু-কলার চাকরির জন্য পার্সোনাল স্কিল ট্রেনিং-এরও বন্দোবস্ত করেছে ‘লক্ষ্য’। শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য ছোট্ট এই ক্লাসরুমে হাজির হন বিভিন্ন মোটিভেশনাল স্পিকার এবং মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীরাও। বর্তমানে সবমিলিয়ে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ছাড়িয়েছে সত্তরের কোঠা।
তবে এখানেই সীমাবদ্ধ নেই ‘লক্ষ্য’-র কর্মকাণ্ড। শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিতদের স্বনির্ভর করার লড়াই-এর পাশাপাশি, কখনও হাড়কাঁপানো শীতে কলকাতার পথনিবাসীদের হাতে কম্বল, আবার দুর্যোগের দিনে নানাভাবে সাহায্যও পৌঁছে দিচ্ছেন ‘লক্ষ্য’-র স্বেচ্ছাসেবকরা। সবমিলিয়ে যেন তাঁরা স্বপ্ন দেখাচ্ছেন নতুন দিনের। বিশ্বাস, জয় আসবেই…
Powered by Froala Editor