হেরে গেল পরিবেশ, আদালতের রায়ে শিলমোহর পুরুলিয়ার বিদ্যুৎ প্রকল্পেই

“পরিবেশ দূষণ হচ্ছে, জলবায়ু বদলাচ্ছে – এ-কথা আমরা জানি। আমরা এও জানি যে এই সংকটের হাত থেকে আমাদের বাঁচাতে পারে একমাত্র গাছ। তারপরেও কয়েক লক্ষ গাছ কেটে বিস্তীর্ণ জঙ্গলকে একটা বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দিয়ে কোন উন্নয়ন হবে, সেই প্রশ্নটাই আমরা রাখতে চেয়েছিলাম।” বলছিলেন ‘প্রকৃতি বাঁচাও, আদিবাসী বাঁচাও’ মঞ্চের যুগ্ম আহ্বায়ক রাজেশ্বর টুডু। প্রসঙ্গ, ঠুরগা পাওয়ার স্টোরেজ (Turga Power Storage) সম্পর্কিত কলকাতা হাইকোর্টের সাম্প্রতিকতম রায়। বনবাসীদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের পর ২০১৮ সালে হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চ প্রকল্পটির উপর স্থগিতাদেশ জারি করেছিল। কিন্তু ডিভিশন বেঞ্চে (Division Bench) বিচারপতি সুব্রত তালুকদার এবং বিচারপতি সৌগত ভট্টাচার্যের রায়ে পুরো বিষয়টি বদলে যায়।

২০০৬ সালের বনাধিকার আইনের ভিত্তিতে ঠুরগা পাওয়ার স্টোরেজ প্রকল্পের পুরো প্রক্রিয়াটিকে অবৈধ ঘোষণা করেছিল সিঙ্গল বেঞ্চ। বনাধিকার আইন অনুযায়ী একটি বনাঞ্চলের বিষয়ে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার থাকবে সেই বনগ্রামের গ্রামসভার। গ্রামসভার অন্তত ৫০ শতাংশ সদস্যের অনুমতি ছাড়া কোনো প্রকল্প রূপায়ণ করা যাবে না। এক্ষেত্রে অযোধ্যা এবং বাগমুণ্ডি পঞ্চায়েতের তরফ থেকে যে অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তাতে রয়েছে মাত্র ২১ জনের সই। অথচ সব মিলিয়ে ২৯৪ হেক্টর জমিতে অন্তত ২ হাজার মানুষের বাস। ডিভিশন বেঞ্চের রায়ে বনাধিকার আইনের উপরে স্থান দেওয়া হয়েছে ১৯৭৩ সালে তৈরি পঞ্চায়েত আইনকে। একটি পুরনো প্রশাসনিক আইনের ভিত্তিতে নতুন একটি মানবাধিকার আইনকে কার্যত বাতিল করে দেওয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। বনবাসীদের আন্দোলনের সংহতিতে থাকা পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী সৌরভ প্রকৃতিবাদী বলছিলেন, “ডিভিশন বেঞ্চের এই রায়ের পর আমরা অবশ্যই সুপ্রিম কোর্টে যাব। পাশাপাশি কেন্দ্রের মিনিস্ট্রি অফ ট্রাইবাল অ্যাফেয়ার্সের কাছেও আমরা এই বার্তাটা রাখতে চাই, ২০০৬ সালের যে আইন আপনাদের মুকুটের একটি পালক, তার সঠিক বাস্তবায়নের দায়িত্বটাও আপনারা নিন।”

স্পষ্টতই গতকালের রায়ের পর বেশ খানিকটা হতাশা গ্রাস করেছে আন্দোলনের শরিক এবং অযোধ্যা পাহাড়ের বাসিন্দাদের। তাই বড়োদিনের প্রাক্কালে উৎসব মুখরিত কলকাতা শহরে ছুটে এসেছেন নিজেদের দাবির কথা সোচ্চারে জানাতে। আজ দুপুরে কলকাতা প্রেস ক্লাবে আয়োজন করা হয়েছিল একটি সাংবাদিক সম্মেলনের। অন্যদিকে অযোধ্যা পাহাড় অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে ইতিমধ্যে নতুন করে শুরু হয়ে গিয়েছে আন্দোলনের প্রস্তুতি। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য দাবি করা হয়েছে এই প্রকল্পে পরিবেশের বিশেষ কোনো ক্ষতি হবে না। হাইকোর্টের রায়েও হিসাব করে দেখানো হয়েছে, সব মিলিয়ে হেক্টরপ্রতি ৩০টির বেশি গাছ কাটা হবে না। অবশ্য এক্ষেত্রে গাছ বলতে কেবলমাত্র বৃক্ষ শ্রেণির বড়ো গাছেদের কথাই বলা হয়েছে। রাজেশ্বর তাই প্রশ্ন করেন, “তাহলে ঔষধি গাছেদের কী হবে?” কারণ প্রজন্মের পর প্রজন্ম অরণ্য অঞ্চলে বসবাসের ফলে তাঁরা জানেন, ছোটো গাছ না থাকলে বড়ো গাছেদের পক্ষে বেঁচে থাকা এমনিই সম্ভব হয় না। আবার হাইকোর্টের রায়ে পূর্ববর্তী পুরুলিয়া পাওয়ার প্রোজেক্টের প্রসঙ্গও আনা হয়েছে। এই প্রকল্প অরণ্য ও বন্যপ্রাণের কোনো বিপদ ডেকে আনেনি বলেই উল্লেখ করা হয়েছে। রাজেশ্বরের স্পষ্ট বক্তব্য, “আসুন আমার সঙ্গে, তারপর নিজের চোখেই দেখুন পরিস্থিতি কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে।” পাশাপাশি তাঁর বক্তব্য, “পুরুলিয়া পাওয়ার প্রোজেক্ট তৈরির সময় হাতিরা এগিয়ে এসে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। বন্যপ্রাণীদের অবস্থা কতটা সঙ্গীন হয়ে উঠলে তারা এভাবে এগিয়ে আসতে পারে!” আর অরণ্য মানে তো শুধু কিছু গাছ নয়। অরণ্য মানে সেখানকার সমস্ত প্রাণী, এমনকি মানুষও। রাজেশ্বর তাই বলছিলেন, “এই প্রকল্প হলে ৯টি গ্রামের বাসিন্দারা সরাসরি উচ্ছেদ হবেন। ২৭টি গ্রামের বাসিন্দারা জীবিকার সূত্রে এই অরণ্যের উপর নির্ভরশীল। তাঁরা জীবিকা থেকে উচ্ছেদ হবেন। আর ৬২টি গ্রামের মানুষের কাছে মারাং বুরু পাহাড় দেবতা। এই প্রকল্প হলে সেই পাহাড়ের অস্তিত্বই হারিয়ে যাবে। ফলে তাঁরা উচ্ছেদ হবেন সংস্কৃতি থেকে।”

ঠুরগা মামলা প্রসঙ্গে রীতিমতো চিন্তার মেঘ জমেছে পরিবেশকর্মীদের মনে। কারণ বিষয়টি এখন আর কেবলমাত্র অযোধ্যা পাহাড়ের মামলা হয়ে নেই। একটি হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায় দেশের সমস্ত আদালতের কাছে উদাহরণ হয়ে থাকে। ফলে সারা দেশজুড়ে অসংখ্য পরিবেশ আন্দোলনের সামনে একটা বাড়তি প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করল এই রায়। তবে এর পরেও হাল ছাড়তে রাজি নন আন্দোলনকারীরা। সৌরভ বলছিলেন, “আদালতকে সম্মান দিয়েই তাঁদের কাছে হাজির হয়েছিলাম। কিন্তু প্রশাসনিক জাঁতাকলে মানুষের অধিকারের প্রশ্নটা আবারও হারিয়ে গেল। দেশের উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষদের পক্ষে সবসময় সুপ্রিম কোর্টে দরবার করা কতটা সম্ভব জানি না। তবে আমাদের লড়াই করতেই হবে।” পাশাপাশি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার এবং প্রশাসনের সমস্ত মহলকে আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়ে আরও মানবিক হওয়ার আবেদনও রাখলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ঠুরগা প্রকল্পের ভবিষ্যত কোনদিকে এগোয়, তা জানতে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের অপেক্ষা করতেই হবে।

Powered by Froala Editor

More From Author See More