“আজকে ওড়িশির যে ফর্মটা আমরা দেখি, সেটার স্ট্রাকচার তৈরি করেছিলেন গুরুজি কেলুচরণ মহাপাত্র। শুধু গুরুজি নন, ওড়িশার বিভিন্ন সঙ্গীতশিল্পী, ভাস্কর, চিত্রশিল্পী ও অন্যান্য সৃজনশীল ব্যক্তিত্বরা সকলে মিলে হারিয়ে যেতে বসা কয়েকশো বছরের প্রাচীন এই ধারাটিকে নতুন করে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন।”
বলছিলেন নৃত্য প্রতিষ্ঠান ‘দর্পণী’-র কর্ণধার এবং নৃত্যশিল্পী অর্ণব বন্দ্যোপাধ্যায়। পঞ্চাশের দশকে যে নৃত্যকলা কেবলমাত্র পরিচিত ছিল ওড়িশার কিছু অঞ্চলেই, সেই ওড়িশিই আজ ভারতের দ্বিতীয় সর্বাধিক জনপ্রিয় নৃত্যশিল্প। ওড়িশির এই বিস্তার, জনপ্রিয়তা এবং গৌরবের পিছনে প্রধান ভূমিকা গুরু কেলুচরণ মহাপাত্রেরই (Kelucharan Mahapatra)। গত ৮ জানুয়ারি পেরিয়ে গেল কিংবদন্তি নৃত্যশিল্পীর ৯৭তম জন্মদিন। আর এই দিনটিকে কেন্দ্র করেই কলকাতার বুকে আয়োজিত হল দু’দিন ব্যাপী বিশেষ এক অনুষ্ঠান। বিশেষ সম্মাননা জানানো হল ওড়িশির অন্যতম প্রাণপুরুষকে।
গত ৭ ও ৮ জানুয়ারি, কলকাতার সত্যজিৎ রায় অডিটোরিয়ামে আয়োজিত হয়েছিল এই বিশেষ নৃত্যানুষ্ঠান। নেপথ্যে ‘দর্পণী’। বিশিষ্ট অতিথি হিসাবে হাজির ছিলেন অলকানন্দা রায়, গুরু অনিতা মল্লিক, কত্থক নৃত্যশিল্পী অসীমবন্ধু ভট্টাচার্য, রবীন্দ্র গবেষক অমিত দাশগুপ্ত-সহ একাধিক খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব। বিশেষ নৃত্য পরিবেশন করেন সঙ্গীত নাট্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত গুরু সুজাতা মহাপাত্র। সম্পর্কে তিনি গুরুজি কেলুচরণ মহাপাত্রের ছাত্রী এবং পুত্রবধূও বটে। ছিলেন বেঙ্গালুরুর ভারতনাট্যম শিল্পী সত্যনারায়ণ রাজু, কলকাতার কত্থকশিল্পী লুনা পোদ্দার এবং মণিপুরী শিল্পী বিম্বাবতী দেবী। তাছাড়াও নৃত্য পরিবেশন করেন দর্পণীর শিক্ষার্থীরাও।
সবমিলিয়ে এ যেন গঙ্গা জলেই গঙ্গাপুজো। নৃত্য মহোৎসবের মধ্যে দিয়েই সম্মাননা জ্ঞাপন আরেক কিংবদন্তি নৃত্যশিল্পীকে। “বিগত ৩ বছর ধরেই, অর্থাৎ ২০২০ সাল থেকে প্রতিবছর আমরা এই বিশেষ অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে চলেছি”, জানালেন অর্ণববাবু। এও জানা গেল, কেলুচরণ মহাপাত্রের স্মরণে দর্পণীর পক্ষ থেকে প্রতিবছর প্রদান করা হয় বিশেষ স্মারক সম্মাননা। চলতি বছরে সেই পুরস্কার পেয়েছেন নৃত্যশিল্পী সুতপা তালুকদার এবং নাট্যব্যক্তিত্ব সোহাগ সেন।
কথায় কথায় উঠে এল পঞ্চাশের দশকের কথা। অর্ণববাবু গল্পের ছলেই জানালেন, ১৯৫২ সালে দিল্লিতে প্রথম একটি কনফারেন্সে এই নৃত্যশৈলীটিকে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব ওঠে। তবে দীর্ঘদিন এই বিশেষ ধ্রুপদী নৃত্য চর্চায় ছেদ পড়ার কারণে তখনও পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট ফর্ম ছিল না এই নাচের। এমনকি ওড়িশি নামটিরও জন্ম হয়নি তখনও। ইতিহাস দেখতে গেলে ‘গতিপুয়া’ ও ‘মাহারি’ নামে দুটি ধ্রুপদী নৃত্যশৈলীর জন্মস্থান ওড়িশা। মূলত, এই নৃত্যশিল্পের চর্চা করতেন মন্দিরের দেবদাসীরা। তবে কালের আবহেই গঠন হারিয়েছিল সেই নাচ। অর্ণববাবুর কথায়, “শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্প থেকে তা হয়ে উঠেছিল লোকশিল্প। পরবর্তীতে তাকে আবার ফিরিয়ে আনা হয় শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পের ব্যাকরণে।”
তবে খুব একটা সহজ ছিল না কাজটা। কারণ, ওড়িশির মূল ঐতিহাসিক নথি ‘অভিনয় চন্দ্রিকা’ তখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। তালপাতায় লেখা এই প্রাচীন পুঁথির অনুসন্ধানেই গবেষণায় নেমেছিলেন কেলুচরণ মহাপাত্র। শুধু তিনিই নন, এই উদ্যোগে সামিল ছিলেন ওড়িশার বিভিন্ন ক্ষেত্রের সৃজনশিল্পীরা। যাঁদের মধ্যে অন্যতম শ্যামসুন্দর লাল, মোহন মহাপাত্র, সদাশিব রথ শর্মা, মায়াধর রাউথ, কালীচরণ পট্টনায়ক, পঙ্কজরঞ্জন দাস, দেবপ্রসাদ দাস প্রমুখ ব্যক্তিত্ব। ১৯৫৭ সালে তাঁদের নিয়েই গড়ে ওঠে একটি বিশেষ সংগঠন— ‘জয়ন্তিকা’। এই জয়ন্তিকার হাত ধরেই পরবর্তীতে সূচনা হয় ‘ওড়িশি’-র। উল্লেখ্য, এই নামটির নেপথ্যে রয়েছে সঙ্গীতবিদ, নৃত্যশিল্পী ও ঐতিহাসিক কালীচরণ পট্টনায়ক।
বিশ শতকের শেষের দিক থেকেই ওড়িশার পরিধি ছাড়িয়ে সারা ভারতজুড়েই জনপ্রিয়তা লাভ করে এই ঐতিহ্যবাহী নৃত্যশিল্প। পরবর্তী মিস ইন্ডিয়া এবং ওড়িশি-শিল্পী ইন্দ্রাণী রহমানের হাত ধরে এই নৃত্যশিল্প পা রাখে ভারতের বাইরে। হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক। তিনিও গুরুজি কেলুচরণ মহাপাত্রের শিক্ষার্থী। অর্ণববাবু নিজেও প্রশিক্ষণ পেয়েছেন কেলুচরণ মহাপাত্রের থেকে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ওড়িশির ধারাকে জীবিত রাখার দায়িত্ব যেন তাঁর কাঁধেই। আর এই নৃত্যচর্চার মাধ্যমেই তাঁর নৃত্য প্রতিষ্ঠান বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে শতাব্দীপ্রাচীন এই গুরুশিষ্যের পরম্পরাকে…
Powered by Froala Editor