ষাট-সত্তরের দশকের কলকাতায় দাপিয়ে বেরিয়েছেন তিনি। তাঁর নাম শোনেনি, এমন মানুষ সেই সময় পাওয়াই দুষ্কর ছিল। কলকাতার সেই রাতের রানি, আরতি দাস ওরফে মিস শেফালি প্রয়াত হলেন আজ। রাতের শহর মাতিয়ে রাখতেন, তাই রাতটুকু কাটতে না কাটতেই চলে গেলেন চিরঘুমের দেশে। ফিরপো’জ থেকে গ্র্যান্ড হোটেল, পার্ক স্ট্রিট— সমস্ত জায়গায় ভিড় জমত শুধু তাঁর নাচ দেখার জন্য। এই গোটা যাত্রায় যেমন এসেছে প্রচুর সম্মান, তেমনই জুটেছে নানা অপবাদ। দুঃখ পেয়েছেন, আঘাতও লেগেছে; কিন্তু জীবন থেকে কখনও সরে দাঁড়াননি মিস শেফালি। তাঁর গল্পই যে লড়াইয়ের গল্প। একটি দরিদ্র উদবাস্তু পরিবারের মেয়ের প্রথম বাংলা ক্যাবারে ডান্সার হওয়ার গল্প। সর্বোপরি, আরতি দাস থেকে মিস শেফালি হওয়ার গল্প…
এক সময় ক্যাবারে নাচের জগতে একচ্ছত্র অধিকার ছিল বিদেশি ও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়েদের। সর্বপ্রথম সেই ধারণা ভাঙলেন আরতি দাস। বাঙালি, দরিদ্র মেয়ে হয়ে ক্যাবারের স্বল্প পোশাকে নাচবে! বাংলার সংস্কৃতি রে রে করে উঠেছিল। কিন্তু সেসবকে তুড়ি মেরে উড়িয়েছেন তিনি। শহরের অভিজাত সমাজের কাছে প্রিয় পাত্রী হয়ে উঠলেন তিনি। আরতি হলেন রাতের রানি ‘মিস শেফালি’। ব্যক্তিত্ব ছিল বরাবর। তাঁর অনুমতি ভিন্ন কেউ ছোঁয়ারও সাহস দেখাত না। সম্মানও পেয়েছেন; এসেছে অর্থ। এই দ্বিতীয় জিনিসটিরই বড়ো প্রয়োজন ছিল আরতি’র। ছোটো বয়স থেকেই কাজে নেমে পড়া তাঁর। পড়াশোনাও বিশেষ করা হয়ে ওঠেনি। পরিবারের পাশে তখন দাঁড়াতে হবে।
কিন্তু শুধু ক্যাবারেই থেমে থাকেননি মিস শেফালি। থিয়েটার, সিনেমা, যাত্রা— আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়েছিলেন সমস্ত জায়গায়। প্রথমে বাধ্য হয়ে ঢুকলেও, পরে নেশা লেগে যায় তাঁর। থিয়েটারের নেশা, অভিনয়ের নেশা।
একবার ফিরপো’জের লিডো রুমে ছিলেন মিস শেফালি। দেখেন, সেখানেই বসে আছেন একজন লম্বা মতন লোক। গলার আওয়াজটাো বেশ ভরাট। এক মুহূর্ত দেখেই চিনে ফেললেন তিনি। এ তো সত্যজিৎ রায়! শেফালিকেও লক্ষ্য করেন কিংবদন্তি পরিচালক। তারপর থেকেই ওঁর ইউনিট থেকে শেফালির কাছে ফোন আসতে থাকে। বারবার এড়িয়েও যেতেন তিনি। একদিন ফোন ধরার পর, তাঁকে বলা হল সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে যেন একবার আসেন।
বিশপ লেফ্রয় রোডের সেই বিখ্যাত বাড়ির ততধিক বিখ্যাত চেয়ারে সেদিন বসেছিলেন সত্যজিৎ। সঙ্গে ছিলেন বিজয়া রায় ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ সিনেমাটা তখন তৈরির কথা ভাবছেন তিনি। সেই সূত্রেই শেফালিকে, মানে আরতি দাসকে ডেকে পাঠিয়েছেন পরিচালক। সমস্ত দৃশ্য, চরিত্র বোঝানোর পর ওকে অন্যঘরে নিয়ে গেলেন সত্যজিৎ। একটি দৃশ্যে কথা বলতে বলতে নার্সের পোশাক খুলবেন শেফালি। সেই সিনে তাঁর কোনো আপত্তি আছে কিনা, সেটাই জানতে চান পরিচালক। পরবর্তীতে মিস শেফালি বলেছিলেন, “উনি জানেন আমি হোটেলে ক্যাবারে করি। শরীর দেখানো নিয়ে আমার কোনো সংকোচ নেই। কিন্তু উনি যেহেতু ওঁর সিনেমায় আমার শরীরটাকে এভাবে ব্যবহার করতে চান, তাই আমার সম্মতি নিয়ে নিচ্ছেন। আমার সত্যিই খুব ভালো লেগেছিল সেদিন। খুব সম্মানিত লেগেছিল। সত্যজিৎ রায়কে মনে হয়েছিল, হি ডাজ নো হাউ টু ট্রিট এ লেডি।” এই সম্মানের আশাই সারাজীবন করে এসেছেন তিনি। অনেকের কাছ থেকে তার কণাটুকুও পাননি। কিন্তু সত্যজিতের কাছ থেকে সারাটা সময় তিনি সেটাই পেয়ে এসেছেন। মৃত্যুর আগ অবধিও সেই কথা স্মরণ করে গেছেন তিনি।
আদ্যোপান্ত বাঙালি শেফালি, আর সময়টাও ষাট-সত্তরের দশক। কাজেই, উত্তমকুমারের ছোঁয়া আসবে না, তা কি হয়! একবার প্রিন্সেসের অনুষ্ঠানে বড় বড় গেস্টরা আসবেন। নাচ দেখানোর কথা মিস শেফালির। শুরুর আগে গেস্ট লিস্টটা পরীক্ষা করতেই তাঁর মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়! এ কি দেখছেন? উত্তমকুমার আসবেন প্রিন্সেসে! প্রথমে একটু ধুকপুকানি হয়েছিল বটে, কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেন তিনি। উনি উত্তমকুমার তো কী হয়েছে; আমিও তো মিস শেফালি! ডান্স ফ্লোরে পা দেওয়ার পর তো আর কিছু খেয়াল থাকত না তাঁর।
সেদিন উত্তমের সঙ্গে এসেছিলেন সুপ্রিয়া দেবীও। নাচতে নাচতে ওঁর গলায় মালা পরিয়ে দিয়েছিলেন শেফালি। তারপর হাত ধরে সোজা স্টেজে নিয়ে গেলেন উত্তমকুমারকে। হাওয়াইয়ান নাচ নাচতে হবে যে! কিন্তু দুরন্ত শেফালির পাশে যেন খেই হারিয়ে ফেললেন বাঙালির স্বপ্নের পুরুষ। টাল সামলাতে পারছেন না নাচতে নাচতে। শেফালিও নাছোড়বান্দা। শেষে উত্তম কুমার বলেই বসলেন- “এবার থামো! এবার না থামলে কিন্তু আমি পড়ে যাব। আমি কিন্তু আর নাচতে পারব না!” হাসিমুখে নেচে যাচ্ছেন, সঙ্গে সমানে বলে যাচ্ছেন এই কথা। ইমেজের দায় যে বড় দায়…
পরে অবশ্য উত্তম কুমার আর ওঁর পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল শেফালির, থুড়ি আরতি’র। তখন ক্যাবারে জগত থেকে বেরিয়ে থিয়েটার, যাত্রা, সিনেমায় এসেছেন তিনি। ‘সাহেব বিবি গোলাম’ নাটকে চুনীদাসীর চরিত্রে অভিনয় করছিলেন তিনি। নাটক দেখতে এসেছেন স্বয়ং উত্তমকুমার। নাটকের পর ডাক পড়ল মহানায়কের, চুনীদাসী কোথায়? সেদিন থেকেই উত্তম কুমারের কাছের মানুষ হয়ে গেলেন তিনি। ‘আপনি’ থেকে কখন যে ‘তুমি’ হয়ে প্রিয় দাদা হয়ে উঠলেন তিনি, বুঝতেই পারলেন না।
এইভাবেই আলাপ সুচিত্রা সেনের সঙ্গেও। একটা পার্লারে স্টিম বাথ নিচ্ছেন শেফালি, হঠাৎ পিছন থেকে কে একজন পিঠে চাঁটি মারল! কার এত সাহস? তাকিয়ে দেখেন, দাঁড়িয়ে স্বয়ং মিসেস সেন! সেখান থেকেই বাড়ে সখ্য। পরে নিজে সিনেমা করতে গিয়ে বুঝেছেন সুচিত্রা সেনের মাহাত্ম্য। বাংলা সিনেমা জগতে এরকম দাপট যে স্বয়ং মহানায়কেরও ছিল না, সেই কথা অকপট স্বীকার করেছেন তিনি।
সম্মান এসেছিল অমিতাভ বচ্চনের কাছ থেকেও। ‘দো আনজানে’ ছবির শুটিংয়ের সময় দুজনের আলাপ। সেখান থেকে বন্ধু হয়ে ওঠা। কলকাতায় আসলে তখন যেখানেই যেতেন, সঙ্গে থাকতেন শেফালি। একসময় বম্বেতেও গেছেন। স্বয়ং হেলেনও তাঁর প্রশংসা করেছেন। শেফালি যে নিজেই তখন কলকাতার ‘হেলেন’!
সব রূপকথাই একদিন শেষ হয়। সেখানে শুধু আলো ঝলমল রাতের কথাই থাকে না, থাকে অন্ধকার গলির কথাও। মিস শেফালি, ওরফে আরতি দাসের জীবনেও অন্যথা হয়নি। গোটা বঙ্গ সমাজ তাঁকে একজন ক্যাবারে ডান্সার হিসেবেই চিনে গেল। কিন্তু যে সম্মান এই মানুষগুলোর কাছ থেকে পেয়েছেন, সেটা তো হারিয়ে যাবে না! বারবার লিখতে গিয়ে নাম গুলিয়ে যাচ্ছিল। আরতি, না শেফালি? কোনটা তাঁর নাম? যে নামে জন্ম হয়েছিল তাঁর, নাকি যে নাম তাঁকে দিল যশ, খ্যাতি, অর্থ, অপমান? কাঁটাতারের ওপার থেকে যে সংগ্রামের জীবন শুরু হয়েছিল, আজ তা চিরতরে স্থান পেল চিতার আগুনে। বাংলা হারাল তাঁর ক্যাবারে অভিনেত্রীকে…
ঋণ- সন্ধ্যারাতের শেফালি, শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়