“যে বিষণ্ণতা এবং বিপন্নতার মধ্যে আমরা আছি, এখন শঙ্খবাবুর একটি লাইন ধার করেই বলতে ইচ্ছা করে, ‘আমার দুঃখের কাছে তোমাদের নত হতে হবে।” গতকাল বৈদ্যুতিন মাধ্যমে সম্প্রচারিত শঙ্খ ঘোষ স্মৃতি অনুষ্ঠান ‘স্পর্ধার জন্য’-র শেষে নিজের এমন অনুভূতির কথাই জানালেন অনুষ্ঠানের আয়োজক অভিনেতা সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। গত মাসে করোনা ভাইরাস কেড়ে নিয়েছে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম মহীরুহ কবি শঙ্খ ঘোষকে। এই বিষাদের মধ্যেই কবির কাছে আজকের শিল্পীদের নিবেদন উঠে এল সিপিসি ক্রাফট আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে প্রথম আলাপের কথা বললেন মালয়ালি কবি তথা স্কলার কে. সচ্চিদানন্দ। সেটা ১৯৮০-র দশকের কথা। তার মধ্যেই যে শঙ্খ ঘোষের কবিতার ভাষা সারা ভারতের তরুণ কবিদের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছিল, সেই কথাই উঠে এল কে. সচ্চিদানন্দনের স্মৃতিচারণায়। আবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি শিক্ষক শঙ্খ ঘোষের কথা উঠে এল তাঁর একদা ছাত্রী শিল্পী চৈতালী দাশগুপ্তের কথায়। কবির মৃত্যু হলেও এই অনুপ্রেরণা, এই শিক্ষার তো মৃত্যু নেই। সেইসবকিছু তিনি তুলে দিয়ে গিয়েছেন পরবর্তী প্রজন্মের হাতে। “বাংলার যে কয়েকজন শিল্পীর ভাষা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে, শঙ্খবাবু ছিলেন তাঁদের সকলের অভিভাবকের মতো।” বলছিলেন সুজয়প্রসাদ।
প্রায় দেড় ঘণ্টার অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়, মমতাশঙ্কর, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, অনন্যা চট্টোপাধ্যায়, নন্দনা সেন, বিয়জলক্ষ্মী বর্মণ, প্রণতি ঠাকুর-এর মতো একাধিক শিল্প। কবির কবিতা দিয়েই শেষ প্রণতি জানালেন শিল্পীরা। শঙ্খ ঘোষের কবিতা পাঠ করলেন অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর। শঙ্খ ঘোষের ‘সন্ধ্যানদী জল’ কবিতাটি পাঠ করলেন নবনীতা-কন্যা নন্দনা দেবসেন। শঙ্খ ঘোষের কবিতার অনুবাদ পাঠ করলেন সম্পাদক অরুণাভ সিনহা ও কবি সুবোধ সরকার। আবার প্রমিতা মল্লিক, লোপামুদ্রা মিত্র, প্রবুদ্ধ রাহা, জয়তী চক্রবর্তী, ঋতপা ভট্টাচার্য, সুছন্দা ঘোষ, প্রিয়ম মুখোপাধ্যায়, রোহিনী রায় চৌধুরী-সহ খ্যাতনামা শিল্পীদের রবীন্দ্রসঙ্গীতে আবেগঘন হয়ে উঠেছিল সমগ্র নিবেদন। রবীন্দ্রনাথের কাছেই তো বারবার আশ্রয় খুঁজেছেন শঙ্খ ঘোষ নিজেও। তাই অনুষ্ঠানের শেষেও রেশ রেখে যায় রঞ্জিনী মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে…”
আরও পড়ুন
গান-কবিতার মাধ্যমে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন, শঙ্খ ঘোষের স্মরণে বিশেষ উদ্যোগ শিল্পীদের
আরও পড়ুন
জার্মান ভাষায় রবীন্দ্র-কবিতা, পাঠোদ্ধারে সহায় শঙ্খ ঘোষ
আরও পড়ুন
বাংলা সাহিত্যজগতে নক্ষত্রপতন, প্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষ
সুজয়প্রসাদ বলছিলেন, “এই অনুষ্ঠান সফল করতে সমস্ত শিল্পীরা যেভাবে এগিয়ে এসেছেন, তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার নেই। তবে সবার থেকে আলাদা করে দুজনের কথা বলতে চাই। অনুষ্ঠানের প্রচ্ছদ ও সম্পাদনার দায়িত্বে ছিল উত্তরণ দে। এই বয়সে ওর কাজের এমন দক্ষতা ও নিষ্ঠা প্রসংশা না করে উপায় নেই। আর অনুষ্ঠানের সৃজনে ছিল আমারই ছাত্রী চন্দ্রিমা চট্টোপাধ্যায়। ওরা না থাকলে এত সুন্দর একটা অনুষ্ঠান উপহার দিতে পারতাম না।” অনুষ্ঠানের শেষে দেশবিদেশ থেকে ইতিমধ্যে প্রশংসা পেয়েছেন আয়োজক সুজয়প্রসাদ। তবে এতকিছুর মধ্যেও, তাঁর কথায়, “অনুষ্ঠান শেষ হতেই খবর পেলাম সাংবাদিক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রয়াত হয়েছেন। একের পর এক মৃত্যুর মধ্যে কোনো প্রশংসাই মনকে তৃপ্তি দিচ্ছে না। শঙ্খ ঘোষের মতো কিংবদন্তি মানুষের প্রয়াণের পরেই বা কতটুকু শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ পেলাম আমরা? করোনা অতিমারীতে সমস্ত আয়োজনই তো বন্ধ।” তবে অনুষ্ঠান তো শুধুই কবিকে স্মরণ করার জন্য। সুজয়প্রসাদের কথায়, “অনুসঙ্গ কখনও উপলক্ষকে ছাপিয়ে যেতে পারে না।” কবি তাই মৃত্যুর পরেও থেকে গিয়েছেন বর্তমানের মনের মধ্যে। রেখে গিয়েছেন সোচ্চারে সত্যি কথা বলার স্পর্ধা। সেই ‘স্পর্ধার জন্য’ই তো নিবেদিত কিছুটা আয়োজন।
Powered by Froala Editor