সমুদ্রের ঠিক ধার ঘেঁষেই গড়ে উঠেছে একটি গ্রাম। নোনা জল এসে মিশে যায় মাটিতে, আরেকটু ভিতরে ঢুকলে হাজির হবে বিস্তীর্ণ সবুজ ক্ষেত। একপাশে সার সার বাড়ি। ভারতের আর পাঁচটা গ্রামের মতোই চেহারা কেরালার কোদিনহি’র। ছোট্ট গ্রাম, জনসংখ্যাও কম। প্রকৃতির কোল ঘেঁষে শান্ত পরিবেশ সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। যদি কেরালায় ঘুরতে ঘুরতে কখনও কোদিনহি গ্রামে পৌঁছন, আপাতদৃষ্টিতে কোনো বিশেষত্ব চোখে পড়বে না। তাহলে? আরেকটু গ্রামের ভেতর ঢুকুন। সেখানকার মানুষগুলোর দিকে লক্ষ্য রাখুন। খটকা লাগছে কি? চোখের ভ্রম, নাকি সত্যিই আপনার চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে যমজ মানুষেরা? যদি সত্যিই এমন দোটানায় ভোগেন, তাহলে স্বাগত আপনাকে! স্বাগত ভারতের ‘যমজ গ্রাম’ কোদিনহি-তে…
‘হোরাশিও, স্বর্গ ও মর্ত্যে এমন অনেক জিনিস আছে যা তোমার আমার ভাবনার অতীত’— শেক্সপিয়রের হ্যামলেটের এমন উক্তি বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে পৃথিবীতে। সত্যি, কতই না আশ্চর্য সব ঘটনা আমাদের চারিদিকে ঘটে চলেছে। আর সেই পথ ধরেই হাজির হয় কোদিনহি। মালাপ্পুরম জেলা সদর থেকে বেশ কিছুটা দূরে এর অবস্থান। সব মিলিয়ে হাজার দুয়েকের মতো পরিবার বাস করেন এখানে। আর সেখানেই বছরের পর বছর ধরে জন্ম হচ্ছে যমজ সন্তানদের। সাম্প্রতিক হিসেব অনুযায়ী, এই সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ৪৫০ জোড়ায়! প্রায় অর্ধেক গ্রামই যে যমজদের নিয়ে গড়ে উঠেছে! এমনকি বিশেষজ্ঞরা দেখেছেন, গোটা ভারতে যেখানে প্রতি হাজার জনে মাত্র ৪ জন যমজ সন্তানের জন্ম হয়, কোদিনহিতে সেই সংখ্যাটাই প্রায় দশ গুণ বেড়ে দাঁড়িয়ে যায় ৪৫ জনে!
এমন ঘটনা যে খুব সাম্প্রতিক, তাও নয়। বিগত বহু বছর ধরে এই ছবিটাই কেরালার এই গ্রামের স্বাভাবিক ছবি হয়ে উঠেছে। আশ্চর্যের ঘটনা এখানেই থেমে নেই। এই গ্রামের কোনো পুরুষ বা মহিলা অন্য জায়গায় গিয়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেও দেখা গেছে, তাঁদের যমজ সন্তান প্রসব হয়েছে। একবার নয়, বেশ কয়েকবার। এবং যত দিন যাচ্ছে, যমজদের সংখ্যাও বাড়ছে। এমন অদ্ভুত ঘটনার কথা শুনেছেন কখনও?
এটা কি সম্পূর্ণ কাকতালীয়? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে কোনো গভীর রহস্য? কোদিনহির বাসিন্দাদের দাবি, এসবই ঈশ্বরের দান। স্বয়ং ওপরওয়ালার আশীর্বাদ ও দোয়া রয়েছে এই গ্রামের ওপর। গ্রামে কোনোরকম অসৎ উপায় অবলম্বন করা হয় না। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক পদ্ধতিতেই সন্তান প্রসব হয়। তাহলে এই ঘটনার ব্যাখ্যা কী? কেরালা তো ঈশ্বরের আপন দেশ! আর সেখানে তাঁর দোয়া আসবে না, তা কি হয়! অবশ্য বিজ্ঞান এই ব্যাপার মানতে নারাজ। কী আছে রহস্যের অন্তরালে? ২০০৮ সালে স্থানীয় একটি সংবাদমাধ্যমের হাত ধরে যখন প্রথম সামনে এল কোদিনহির কথা, তখন থেকেই বিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে গ্রামটি। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তো বটেই, বিদেশ থেকেও বহু গবেষক এখানে এসেছেন। লক্ষ্য একটাই, এই গ্রামের মানুষদের জিনে এমন কী বিশেষত্ব রয়েছে, যার জন্য দেশের একমাত্র ‘যমজ গ্রাম’-এর সৃষ্টি?
জিনগত পরীক্ষার সঙ্গে অন্যান্য শারীরবৃত্তীয় ব্যাপার এবং পরিবেশের কথাও ভেবেছেন তাঁরা। গবেষণা আজও চলছে জোর কদমে। কিন্তু আক্ষেপ, এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। ঠিক কী রয়েছে পর্দার আড়ালে, তা আজও কেবল অনুমেয়। তাঁদের দাবি, কেবল এই কোদিনহি গ্রামকে নিয়েই বড়ো আকারে গবেষণা করা যায়। মানুষের জিন ও শরীরের এমন রহস্যমহল উদঘাটন করলে যে অনেক কিছু জানা যাবে! আজও সেই কাজটিই করে যাচ্ছেন তাঁরা। একদিন হয়ত পর্দা সরিয়ে বেরিয়ে পড়বে সত্যিটি। তবে রহস্য আসুক বা না আসুক, কোদিনহি পৃথিবীর এক বিস্ময় হয়ে থেকে যাবে। হয়তো আরও যমজ সন্তান বাড়বে। ইতিমধ্যেই পর্যটন মানচিত্রে নিজের জায়গা করে নিয়েছে গ্রামটি। প্রতি বছর দেশ-বিদেশ থেকে বহু মানুষ স্রেফ এখানকার মানুষদের দেখতেই আসেন। তৈরি হয়েছে পর্যটন শিল্প। আর্থসামাজিক অবস্থাও বদলে গেছে। সত্যিই, ঈশ্বরের দানই বটে! আর এই ‘দান’ নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে কোদিনহি— ভারতের যমজ গ্রাম…
তথ্যসূত্র-
আরও পড়ুন
নিছক বিমান দুর্ঘটনা নয়; বিজ্ঞানী হোমি ভাবা-র ‘হত্যা’য় হাত ছিল আমেরিকার?
১। ‘This Indian village has 220 pairs of twins. Know the mystery behind it!’, Resham Sengar, Times of India
২। ‘কোদিনহি: ভারতের রহস্যময় যমজ গ্রাম’, জাহিদ হাসান মিঠু, রোর মিডিয়া
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
মোনালিসার হাসি কীভাবে এঁকেছিলেন ভিঞ্চি? পাঁচ শতক পরে সমাধান রহস্যের