ও পারে সুমন, এ পারে আমরা, মেলাবে ডিজিটাল কনসার্ট

বেঙ্গল মিউজিক ফেস্টের ধ্রুপদী শীতের রাতগুলোতে, কোটি কোটি টাকার ইভেন্ট বিনামূল্যে গলাধঃকরণ করার সময় এই প্রশ্ন একবারও আমার মনে আসেনি যে, এই সুর ও সংগীতে বাংলার স্থান ঠিক কোথায়। এ যেন রাজকীয় দরবার থেকে নিঃস্বের দিকে ছুঁড়ে দেয়া মহান আশরাফি। হুড়োহুড়ি কাড়াকাড়ি করে কুড়িয়ে নিয়ে বছরে একবার একবেলার ভালোমন্দ খাবার জুটে যাওয়া।

কিন্তু কবীর সুমন ঘোষণা দিয়েছেন, বাংলা ভাষায় খেয়াল রচনা করা, গাওয়া ও একে যতদূর সম্ভব প্রতিষ্ঠা করে যাওয়া তাঁর জীবনের শেষ ও একমাত্র কাজ। ভারতে হিন্দি, হিন্দুস্তানি, ভোজপুরি, মূলতানি, পাঞ্জাবি, গুজরাটি, রাজস্থানি, মারাঠি এমনকি দরি (ফারসির একটি ডায়ালেক্ট) মোট ন’টি ভাষায় খেয়াল রচিত ও গাওয়া হলেও স্বয়ং বাঙালিরাই বিশ্বাস করতে চান নি যে, বাংলা ভাষাতে খেয়াল সম্ভব। এর আগে এমনকি আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে বাংলা ভাষায় খেয়াল গাওয়ার অনুমতি লাভের জন্য সত্যকিংকর বন্দোপাধ্যায় মামলা মোকদ্দমা পর্যন্ত করেছিলেন। 

কবীর সুমন এক ভাষা সৈনিকের নাম। শুধু খেয়াল রচনা ও গাওয়াতেই নয়, ভারতের অন্য ভাষাগুলোতে খেয়াল আঙ্গিকে বন্দিস (খেয়ালের লিরিক) রচনার একঘেয়ে পুনরাবৃত্তি থেকে বেরিয়ে নতুন ধরনের ভাষা সৃষ্টি করছেন। অষ্টাদশ শতকে মোগল মহম্মদ শাহ রঙ্গিলার দরবার থেকে সঙ্গীতের যে নতুন আঙ্গিকটি শুরু হয়েছিল, কবীর সেই বাদশাহী দরবার থেকে ‘ব্রাত্যজনে’র ভাষায় তার নতুন প্রাণ প্রতিষ্ঠায় কাজ করছেন। ৭২ বছর বয়সেও কালিপদ দাসের এই ছাত্র দিনের একটা দীর্ঘ সময় কাটান রেওয়াজে রেওয়াজে। পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন মঞ্চে খেয়াল গাইছেন। আশ্চর্য! বাংলা ভাষাতে যে আঙ্গিকের কোন সম্ভাবনাই কেউ অনুভব করেন নি, মানুষ প্রবেশমূল্যের বিনিময়েও তা শুনতে আসছেন। লকডাউনের সময় তাঁর ফেসবুক লাইভের ঘরোয়া অনুষ্ঠানগুলোতে শ্রোতার সংখ্যা ছিল অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।

সেই আশার গুড়কে জমাট বাঁধাতে রঙরেইজ আর তাঁরঘর নামে দুটি সংগঠন যৌথভাবে আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর অনলাইনে ‘এক বিশ্ব সুমন’ নামে বাংলা খেয়ালের একটি ডিজিটাল কনসার্টের আয়োজন করেছেন। এতোদিন শুধু দূর থেকেই বন্ধুদের মাধ্যমে কবীর সুমনের নানা অনুষ্ঠানের খবর পেয়েছি। ভাগ্য খুব ভাল হলে, কোন সুমন প্রেমীর হল রুম থেকে কাঁপাকাঁপা হাতে মোবাইলে চুরি করে ধারণকরা বিচ্ছিন্ন শব্দের ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ দেখবার সুযোগ। কিন্তু ডিজিটাল কনসার্টের কারণে পেশাদারি শব্দে একটা আবিশ্ব সুমন শোনার সুযোগ হঠাৎ করেই আমাদের সামনে এসে গেছে। আয়োজকদের আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই। 

আরও পড়ুন
বড়ো চাকরি ছেড়ে ক্রিকেট, ভালোবাসেন গিটার ও সুমনের গান, অনুষ্টুপের জীবন তাঁর ব্যাটিং-এর মতোই ধ্রুপদী

যদিও একেবারে মঞ্চ থেকে সরাসরি সুমন শোনার অভিজ্ঞতা থেকে এই অভিজ্ঞতা হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। নব্বইয়ের দশকে যখন যশোরের মতো একটা মফশ্বল শহরে আমার শৈশবকাল অতিবাহিত হচ্ছে, কাঁটাতার পেরিয়ে সুমন সম্পূর্ণ এক নুতন বাণী ও সঙ্গীত নিয়ে আমাদের কানে ও হৃদয়ে বাসা বাঁধতে শুরু করেছেন। সে সময়ে এক বড় ভাইকে পেয়েছিলাম যিনি ঢাকাতে কবীরের একটি একক অনুষ্ঠান শোনার সুযোগ পেয়েছিলেন। আমরা দীর্ঘদিন ধরে যে কোন আড্ডায়, যে কোন সূত্রে বারবার তাঁর সেই অভিজ্ঞতা শুনতে চাইতাম। তিনি আমাদের চোখে ছিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘চরাচর’ চলচ্চিত্রের সেই চরিত্রটার মতো, সে এমন একজনকে চিনতো, যে সমুদ্র দেখেছিল। ২০০৮ সালে ঢাকাতে প্রথমবারের মতো আমি কবীরের একক অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ পাই। আমার প্রেমিকা আমার পাশে বসে ছিলেন। তখন থেকেই আমি আমার সে অভিজ্ঞতাকে বর্ণনা করার একটা ভাষা খুঁজতে চেষ্টা করেছি আর বোঝার চেষ্টা করে গেছি, কেন কবীরের মঞ্চানুষ্ঠান উপভোগের সময় একজন সঙ্গী সাথে থাকা আবশ্যক। মনে হয়েছে, ভাষা হারিয়ে ফেলার পর বোবা মুখ নিয়ে কারো মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা প্রয়োজন। এমন কেউ, যে নিজেও একই অনুভূতিতে তাড়িত হয়ে তাঁর ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। বাংলাদেশের এক কবি রফিক আজাদ তাঁর কবিতায় লিখেছিলেন, ‘ভালোবাসা মানে শেষ হয়ে যাওয়া কথার পরেও মুখোমুখি বসে থাকা।’ কবীরের একটা মঞ্চানুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করার পরে যেন কথা শেষ হয়ে গিয়ে মুখোমুখি বসে থাকবার মতো ভালবাসা জন্ম নেয়। অচল প্রহরে আবার অনেকখানি দম নিয়ে বাঁচার মতো ভাল লাগা তার পথ খুঁজে নিতে পারে। আমি খুব কৌতুহল নিয়ে অপেক্ষা করছি, ডিজিটাল কনসার্টের ক্ষেত্রেও একই অনুভূতি হয় কি’না তা প্রত্যক্ষ করার। এর একটা গভীর তাৎপর্য আছে।  

কোভিড-১৯ সমগ্র পৃথিবীকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। বিশ্বব্যাপী উদ্যোক্তারা ভাবছেন, ‘অফিস’ নামক একটা স্থান যেখানে মানুষ কাজের জন্য উপস্থিত হয় রোজ, যার জন্য শহরগুলোতে ভীড় বাড়িয়ে বাড়িয়ে তারা মর্মান্তিকভাবে শারীরিক ও মনোবৈকল্যের শিকার হয়েছেন, তার আর প্রয়োজন নেই। একটা ল্যাপটপ আর অন্তর্জালই পৃথিবীর যেকোন প্রান্ত থেকে মানুষের সেই প্রয়োজন মিটিয়ে দিতে পারে। গিটারের নাইলন স্ট্রিং বাজিয়ে রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া কবীর সুমন বরাবরই তাঁর জীবন, কাজ ও ভাবনায় নতুন প্রযুক্তিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। ২০০০ সালের গোড়ার দিকে, যখন আমাদের ‘ইন্টারনেট’ শব্দটার সাথেই অনেকের পরিচয় হয়নি, এমনকি আলীবাবার প্রতিষ্ঠাতা জ্যাকমা’ও তখন পর্যন্ত ভাবেন নি যে তিনি পৃথিবী ব্যাপী ই-কর্মাসের প্রধান উদ্যোক্তা হয়ে উঠবেন, সে সময়ে কবীর তাঁর ‘ছুটি.কম’ গানে গাইছেন- 


আরও পড়ুন
ব্যক্তিগত প্রেমে মিশে গেল কলকাতাও, ঝড়ের বেগে ‘তোমাকে চাই’ লিখলেন কবীর সুমন

‘সবই দেখি পাওয়া যায় কম্পিউটারটায় যদি টাকা থাকে

টাকাটাই বড় কথা, বাকি সব বাতুলতা টাকা কথা রাখে’

এমন একজন আধুনিক মানুষের পক্ষেই যে ডিজিটাল কনর্সাট করার কথা ভাবা সম্ভব, এ তো নতুন কিছু নয়। তবে ঐতিহাসিকভাবে নতুন হচ্ছে- কনসার্টটা বাংলা খেয়ালের। বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম যেমন বিশ্বাস করতেন, এই পৃথিবীটা একদিন বাউলের পৃথিবী হবে। তেমনি কবীর সুমন বিশ্বাস করেন, বাংলা ভাষাটাও একদিন খেয়ালের হবে। আসলে এখনই তা হচ্ছে। চাইলে আপনার কানকে সেই অভিজ্ঞতার শরিক করতে পারেন।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
‘#ভাগ্যিসসুমনছিলেন’, সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদের অস্ত্র হয়ে উঠছে কবীর সুমনের গান

Latest News See More