রাস্তার একদম ঠিক গা ঘেঁষেই উঠে গেছে প্রকাণ্ড এক বাড়ি। জীর্ণ অবস্থা। খসে গেছে দেওয়ালের পলেস্তারা। ভেতর থেকে উঁকি দিছে ইট। দেওয়ালের ফাটলে বেড়ে উঠছে বট-অশ্বত্থের চারা। এই বাড়ির গায়েই ঝুলছে হলুদ ফলক। তাতে কালো হরফে বড়ো বড়ো করে লেখা ‘সাবধান!’ উত্তর কলকাতার গলি-উপগলি ধরে হাঁটতে থাকলে হামেশাই চোখে পড়বে এধরনের বহু প্রাচীন বাড়ি। অথচ, তাও সেখানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করে মানুষ। কোথাও আবার মানুষের বসবাস না থাকলেও, এই বাড়িগুলিকে টিকিয়ে রেখেছেন তার মালিক।
কলকাতা শহরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এহেন ৩ হাজারেরও বেশি ভবনকে ‘বিপজ্জনক বাড়ি’ (Dangerous House) হিসাবে চিহ্নিত করেছিল কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন (KMC)। ঝড়-বৃষ্টি-সাইক্লোন কিংবা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে যে-কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে এই বাড়িগুলি, জানাচ্ছে কেএমসির সমীক্ষা। বাসিন্দারা তো বটেই, তাতে প্রাণহানি হওয়ার আশঙ্কা প্রতিবেশী এমনকি পথচলতি যাত্রীদেরও। এবার এধরনের ১২০০ ‘অনিরাপদ’ বাড়িকে ভেঙে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু করল কেএমসি। আগামী বর্ষার আগেই ভেঙে ফেলা হবে জরাজীর্ণ ভবনগুলিকে।
উত্তর কলকাতা ছাড়াও মধ্য কলকাতার একাধিক প্রাচীন ভবন রয়েছে এই তালিকায়। এর আগে একাধিকবার কেএমসির পক্ষ থেকে নোটিস পাঠানো হয়েছিল সংশ্লিষ্ট বাড়িগুলির মালিকপক্ষকে। অনুরোধ করা হয়েছিল বাড়িগুলি মেরামত করার জন্য। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী, বাড়িগুলি খালি করার আদেশও দেওয়া হয়েছিল। তবে প্রত্যুত্তর মেলেনি কোনো। আবার কিছুক্ষেত্রে মালিকদের খুঁজে বার করতেই ব্যর্থ হন কেএমসি কর্তৃপক্ষ।
২০২০-২১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের সময় এবং বর্ষাকালে ধ্বসে পড়েছিল এধরনের বাড়ির বেশ কিছু অংশ। প্রাণ হারিয়েছিলেন সেখানে বাসরত ২০ জন মানুষ। ২০২১ সালেও ঘটেছিল একই ঘটনা। বড়বাজার অঞ্চলে একটি প্রাচীন বাড়ির ছাদ ধ্বসে পড়ে মৃত্যু হয়েছিল দু’জনের। এই ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, তার জন্য গতবছর বিশেষ সংশোধনী আইন প্রণয়ন করেছিল বিধানসভা। ‘অতি-বিপজ্জনক’ চিহ্নিত বাড়িগুলিকে ভেঙে ফেলার সম্পূর্ণ ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছিল কলকাতা পুরসভাকে। এবার সেই সংশোধনী আইনের নিরিখেই বর্ষার প্রাক্কালে ভাঙা হবে ১২০০ বাড়ি।
যদিও কলকাতা পুরসভার এই পদক্ষেপ শেষ পর্যন্ত কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। এখনও পর্যন্ত প্রায় ১০০টি ভবনের ক্ষেত্রে নতুন বিল্ডিং প্ল্যান অনুমোদন করেছেন সংশ্লিষ্ট বাড়ির মালিকপক্ষ। পুরনো কাঠামো ভেঙে, নতুন ভবন নির্মিত হওয়ার পর ভাড়াটিয়াদের যথাযথ পুনর্বাসন দেওয়া হবে, সেই চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে। বাকি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাড়ি ছাড়তে নারাজ ভাড়াটিয়ারা। আসলে যতই বিপজ্জনক হোক না কেন, আশ্রয় আঁকড়েই বেঁচে থাকতে চায় মানুষ। গত বছর বর্ষার পর, এধরনের ভগ্নপ্রায় বাড়ি ভাঙতে গিয়েও জনরোষ ও বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল কেএমসি কর্তৃপক্ষকে। চলতি বছরে কি আদৌ নির্ঝঞ্ঝাটভাবে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারবে কেএমসি? সেই উত্তর দেবে সময়।
Powered by Froala Editor