ভারতবর্ষের মানুষের বিনোদনের এক অচ্ছেদ্য অঙ্গ ঘুড়ি। বিশেষকরে শীতকাল জুড়ে দেশের নানা প্রান্তে মানুষ মেতে ওঠে ঘুড়ি ওড়ানোর খেলায়। ঘুড়ি কাটার প্রতিযোগিতাও চলে। কিন্তু আমরা হয়তো ভেবেও দেখিনা, মানুষের বিনোদনের ফলাফল পাখিদের জন্য কি মারাত্মক হয়ে ওঠে। ঘুড়ির সুতোয় প্রতি বছর কত পাখির প্রাণ কেড়ে নেয়। পিপল ফর দ্য এথিক্যাল ট্রিটমেন্ট ফর অ্যানিমালস (পেটা) ও অন্যান্য সংস্থার পরিসংখ্যানে উঠে আসছে সেই তথ্য। দেশের একেকটি শহরে প্রতিবছর ঘুড়ির সুতোয় জখম হওয়া পাখির সংখ্যা ২০০০ থেকে কোথাও কোথাও ৭০০০-৮০০০ পর্যন্ত।
মানুষের বিনোদনের প্রভাবে নানাভাবে বিপর্যস্ত হয় না-মানুষ প্রাণীরা। কিন্তু আশার কথা এটাই, তাদের বাঁচাতেই আবার এগিয়ে আসেন অনেক মানুষ। যেমন এগিয়ে এসেছেন জয়পুর নিবাসী জয় গার্ডনার। প্রায় দুই দশক জুড়ে বন্যপ্রাণীদের অধিকার রক্ষার উদ্দেশ্যে লড়াই করছেন গার্ডনার। ২০১৫ সালে এই উদ্দেশ্যে তৈরি করেন 'হোপ অ্যান্ড বেয়ন্ড' নামে একটি সংস্থা। দেশের নানাপ্রান্তে উপদ্রুত প্রাণীদের বিশেষত পাখিদের জন্য কাজ করে আসছে এই সংস্থা। আর এবছর জয়পুর ঘুড়ি উৎসব চলাকালীন ৩৫০টির বেশি পাখি উদ্ধার করে এই সংস্থাটি। ১৭ জন ভেটেনারি ডাক্তারের একটি দল তিনদিন ধরে পাখিদের চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলে। তারপর তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয় আকাশে।
জয়পুর ঘুড়ির উৎসব দেশের প্রাচীন ঐতিহ্যশালী একটি উৎসব। প্রতিবছর মকর সংক্রান্তি তিথিতে এই উৎসব হয়। সঙ্গে থাকে ঘুড়ি কাটার প্রতিযোগিতাও। ঘুড়ি কাটার জন্য সুতোয় কাচের গুড়ো লাগিয়ে মাঞ্জা দেওয়ার রীতি অনেক পুরনো। আর এই মাঞ্জার ফলেই পাখিরা ভয়ানকভাবে আহত হয় বলে জানাচ্ছেন গার্ডনার। তাঁর কাজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি দেখেছেন প্রতি বছর এই প্রতিযোগিতা বাড়ছে, আর পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত ও আহত পাখিদের সংখ্যাও। ঘুড়ি ওড়ানোর কাজে সাধারণ কটন বা নাইলনের সুতোও ব্যবহার করা যায়। কিন্তু পাখিদের বাঁচাতে মাঞ্জার ব্যবহার অবিলম্বে বন্ধ করার দাবি রেখেছেন গার্ডনার। সেইসঙ্গে সকালে ও সন্ধ্যায় ঘুড়ি ওড়ানো বন্ধ করার কথা বলেছেন তিনি। কারণ এই সময় পাখিরা দল বেঁধে ওড়ে, আর দুর্ঘটনার সংখ্যাও এইসময়েই সবচেয়ে বেশি।
ঘুড়ি ওড়ানোর ফলে পাখিদের জখম হওয়ার ঘটনা এ'রাজ্যেও নেহাত কম নয়। বিশ্বকর্মা পুজো ও মকর সংক্রান্তিতে রাজ্যের নানা জায়গায় ঘুড়ির লড়াই অনুষ্ঠিত হয়। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে প্রতিবছর কলকাতা ও তার আশপাশের এলাকায় অন্তত ২০০০ পাখি গুরুতর আহত হয়। মৃতের সংখ্যাও প্রায় ৬০০। সারা রাজ্যের হিসাবে যে সংখ্যাটা আরো অনেক বেশি হবে, সেকথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এই শহরেও পাখিদের অধিকারের কথা বলেছেন অনেকেই। কিন্তু আমরা আদৌ সচেতন হচ্ছি তো?
পাখিদের নিজস্ব বাসভূমি আকাশ। মানুষ তার বিনোদনের জন্য পাখিদের জীবনযাত্রা ক্ষতিগ্রস্ত করছে। মানুষ সমস্যা সৃষ্টি করেছে, মানুষকেই সমাধান করতে হবে। তার জন্য কি ঘুড়ি ওড়ানো বন্ধ করে দিতে হবে? না, এমন দাবিও করছেন না বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা চাইছেন প্রতিযোগিতার নেশায় সুতোয় কাচের গুঁড়ো লাগানো বন্ধ করুক মানুষ। একমাত্র ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর কোথাও এরকম মাঞ্জার ব্যবহার করা হয় না। মানুষের বিনোদন থাকুক, কিন্তু তা যেন অপর প্রাণীর মৃত্যুর কারণ হয়ে না ওঠে।