প্রায় তেত্রিশ বছর হয়ে গেল, তিনি আর নেই। বয়স যতই আটান্নতে থেমে থাকুক, তিনি তো ‘কিশোর’! গোটা ভারতের আওয়াজ তিনি, বাঙালিরও গর্ব। কত বছর পেরিয়ে গেছে; মন খারাপ হোক বা আনন্দের মুহূর্ত, আজও বেজে ওঠে সেইসব গান। কিশোর কুমার মানেই ছিল একই আয়নায় বিভিন্ন তবে এই গল্প কিশোর কুমারের জীবনী নয়। সাইন কার্ভের মতো ওঠানামা করে মানুষের জীবন। কখনও আলো, আবার কখনও ঝড়ের দাপটে ভেঙে যায় জানলা। কিশোরের জীবনেও একটা সময় তেমনই ঝড় দেখা দেয়। যার বিপরীতে ছিলেন ক্ষমতার ধ্বজাধারীরা…
সাল ১৯৭৫। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে গোটা দেশে জারি হল জরুরি অবস্থা বা এমারজেন্সি পিরিয়ড। দেশের ইতিহাসের এই অধ্যায়টির কথা নতুন করে নিশ্চয়ই আলোচিত হওয়ার নয়। সংবাদপত্র থেকে শুরু করে সমস্ত গণমাধ্যমের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সমস্ত কিছুর ওপর জারি হয় সেন্সর। সরকারের নির্দেশ না মানলেই সঙ্গে সঙ্গে কারাবাস। মোটের ওপর দেশে স্বাধীনতার পরিসর বলে আর কিছু ছিল না।
১৯৭৬ সালে ইন্দিরা গান্ধী এবং তাঁর মন্ত্রক একটি সিদ্ধান্ত নেয়। তাঁদের সরকারেরও তো কিছু বলার জায়গা আছে; দাবিদাওয়া আছে। ইন্দিরা গান্ধীর বিখ্যাত ২০-দফা নীতি রয়েছে। সেইসব সাধারণ মানুষদের কাছে আরও বেশি করে পৌঁছতে হবে। আর সেই কাজটা করতে পারবেন সেলেব্রিটিরা। সেই সময় বলিউড জগতে যাঁদের জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে, স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের দিকেই নজর পড়ল সরকারের। সত্তরের দশকে গানের জগতে কিশোর কুমার সমস্ত কিছু ছাপিয়ে গিয়েছিলেন। একদিকে তিনি, অন্যদিকে মহম্মদ রফি— দুজনে মিলে একের পর এক স্মরণীয় গান গেয়ে চলেছেন। এদিকে সঞ্জয় গান্ধীর সঙ্গেও ভালো পরিচয় আছে তাঁর। সুতরাং, খবর গেল কিশোরের কাছে…
সেই সময়ের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ছিলেন ভিসি শুক্লা। তাঁর তরফ থেকে বার্তা গেল ‘কিশোর দা’র কাছে। তাঁর গানের মাধ্যমে তখনকার সরকারের কাজ এবং কিছু নীতির যদি প্রচার করে দেন। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী— সব জায়গায় পৌঁছতে এই একজন মানুষই পারতেন। কিন্তু নাকচ করেন কিশোর কুমার। এমন কাজ তিনি কিছুতেই করতে পারবেন না। নিজের গানের মাধ্যমে কিনা সরকারের হয়ে প্রচার করতে হবে! তিনি তো রাজনৈতিক ব্যক্তি নন! নিজের নৈতিক জায়গায় বরাবর অনড় থেকেছেন কিশোর কুমার। এবারেও তাই থাকলেন। জানতেন, বিপদ আসবে। আসুক; কিন্তু এভাবে সমস্ত মেনে নিয়ে কাজ করা যায় না।
যথা সময় ভিসি শুক্লার কাছে খবর পৌঁছল। অতঃপর ইন্দিরা গান্ধীর কাছেও। এরপর যা হওয়ার তাই হল। অল ইন্ডিয়া রেডিও, দূরদর্শন-সহ সমস্ত জায়গা থেকে কিশোর কুমারকে ব্যান করে দেওয়া হল! তাঁর গান শোনাও যাতে না না যায়, সেই ব্যবস্থা পাকা করা হল। তার আগের বছরই সেন্সর বোর্ড আটকে দিয়েছিল ‘আঁধি’ সিনেমাটি। সঞ্জীব কুমার-সুচিত্রা সেন অভিনীত সিনেমায় গানও গেয়েছিলেন কিশোর কুমার।
অবশেষে ১৯৭৬-এর মার্চের পর যখন জরুরি অবস্থা উঠল; তখন আবার কিশোর কুমার ফিরে এলেন গানে। ‘আঁধি’ও মুক্তি পেল। ‘কিশোর’-কে কখনও দমিয়ে রাখা গেছে! আজও তাঁর দৌড় চলেছে সমানভাবে। আর রাজনৈতিক মহড়া? সেটাও চলছে সমানভাবে…
আরও পড়ুন
মুসলিম লিগের সঙ্গী সুভাষচন্দ্র - বলেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সাক্ষী কিশোর মৃণাল
Powered by Froala Editor