বাংলাদেশের ফরিদপুর শহর। আর এই শহরের ডায়াবেটিক হাসপাতাল থেকে বেরিয়েই রয়েছে একটি ছোট্ট দোকান। সেই দোকানে হাজির হলেই চোখে পড়বে একটি অভিনবত্ব। দোকানের বাইরে ঝোলানো রয়েছে একটি প্লাস্টকের ঝুড়ি। সেইসঙ্গে ভিনাইলে প্রিন্ট করা একটি পোস্টারও। নাম ‘খুশির ঝুড়ি’। কিন্তু এর উদ্দেশ্য?
নির্দেশিকায় চোখ বোলালেই পরিষ্কার হয়ে যাবে উদ্যোগের কারণ। শহরের দরিদ্র, ক্ষুধার্ত মানুষেরা যা অভুক্ত না থাকেন, সে জন্যই এমন প্রয়াস নিয়েছেন বাংলাদেশের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘অণুপ্রয়াস’। সে নির্দেশিকাতেই অন্যান্য সকল ক্রেতাদের উদ্দেশ্যে লেখা রয়েছে “চাইলে এই দোকান থেকে খাবার কিনে ঝুড়িতে রাখতে পারেন।”
“বেশ কয়েকশো বছর আগে ওসমানিও খেলাফতের সময় তুরস্কের একটি প্রথা চালু হয়েছিল। দরিদ্র অভুক্তদের জন্য দোকানে ঝুলিয়ে রাখা হত পাউরুটি। কারোর অনুমতি না নিয়েই সেখান থেকে খাবার সংগ্রহ করতে পারতেন ক্ষুধার্তরা। সেই উদ্যোগ তুরস্কের একটি ঐতিহ্য হয়ে গেছে। আজও চলে আসছে সে প্রথা। সেই ঘটনার কথা জানতে পেরেই আমাদের মনে হয়েছিল, আমরাও কিছু একটা করতে পারি কিনে? তুরস্কের সেই প্রথা থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে এই উদ্যোগ নিই আমরা।”
বলছিলেন ‘অনুপ্রয়াস’-এর সভাপতি আরমান দীপ্ত। তুরস্কের প্রাচীন প্রথা ‘আসকিদা একমেক’ বা ‘ঝুলন্ত পাউরুটি’-ই ফরিদপুরে এসে পরিবর্তিত হয়ে গেছে ‘খুশির ঝুড়ি’-তে। তবে শুধু কি পাউরুটিতেই খিদে মিটবে মানুষের? দেশের পরিস্থিতির কথা ভেবেই তাই মূল উদ্দেশ্যটুকু সামনে রেখে আরও কিছু বদল এনেছেন আরমানরা। কেক, বিস্কুট, পাউরুটি, কলা, ওয়েফার এই ধরণের যে কোনো শুকনো খাবার রাখার জন্য সাধারণ মানুষকে আহ্বান করছেন তাঁরা।
তবে শুধু ফরিদপুর হাসপাতালের সামনে নয়, সারা শহরে মোট ১০টি দোকানে এই খুশির ঝুড়ির বন্দোবস্ত রয়েছে ‘অনুপ্রয়াস’। আরমান জানালেন, “আমাদের এই উদ্যোগ দেখে অনেকেই এগিয়ে এসেছেন কাজে। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন সংস্থাই যোগাযোগ করেছিল আমাদের সঙ্গে। অণুপ্রয়াসের নাম না নিয়েই তাঁদের এই কাজ চালিয়ে যেতে অনুরোধ করেছিলাম আমরা। তাঁদের উদ্যোগে সারা বাংলাদেশে আরও ৬০ থেকে ৭০টি দোকানে চলছে খুশির ঝুড়ি।”
আরও পড়ুন
শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশ নয়; আফ্রিকার এই দেশটিরও সরকারি ভাষা বাংলা
প্রথমের কয়েকদিন নিজেরাই খাবার সরবরাহ করেছিলেন সংস্থার সদস্যরা। তবে অণুপ্রয়াসের মূল লক্ষ্য ছিল যাতে এই উদ্যোগের অংশ হয়ে উঠুক সাধারণ মানুষ। চেয়েছিলেন সমাজের দরিদ্র মানুষদের সঙ্গে উচ্চ-মধ্যবিত্তদের মধ্যে নির্মিত হোক একটি সহানুভূতির সেতু। হয়েওছে তেমনটাই। এখন তাঁরাই প্রতিনিয়ত নিচ্ছেন দরিদ্রদের জন্য খাবারের দায়িত্ব। দোকানের সাধারণ ক্রেতারাই কিনে রেখে যাচ্ছেন বিস্কুট, পাউরুটি, কেকের প্যাকেট। তবে সাধারণের ওপর দায়িত্ব দিয়ে, নিজেরা পিছিয়ে যাননি আরমানরা। সুযোগ পেলেই দোকানে গিয়ে তাঁরা রেখে আসছেন শুকনো খাবার। কত মানুষ উপকৃত হচ্ছেন এই উদ্যোগে?
“আমরা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি প্রতি দোকান থেকে ৮ থেকে ১২ জন করে মানুষ খাবার নিয়ে যাচ্ছেন সারা দিনে। অর্থাৎ ১০টা দোকান মিলিয়ে গড়ে সেই সংখ্যাটা দাঁড়াচ্ছে ১০০ জন। তাছাড়াও অন্যান্য সংস্থারাও তো এই উদ্যোগ নিয়েছেন। সেখানো আরও বেশ কিছু মানুষ উপকৃত হচ্ছেন। তবেসেই পরিসংখ্যানটা সঠিকভাবে দিতে পারব না”, জানালেন তিনি।
আরও পড়ুন
একসময় আবর্জনা থেকে কুড়োতেন খাবার, আজ টরেন্টোর মাস্টারসেফ চেন্নাইয়ের ব্যক্তি
কিন্তু কারা চালান এই সংস্থাটি? প্রশ্নের উত্তরে খানিকটা অবাকই হতে হল। কারণ, এই করোনা পরিস্থিতিতে অক্লান্তভাবেই লড়ে যাচ্ছেন তাঁরাই। স্টেথোস্কোপ গলায় ঝুলিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করে যাচ্ছেন মানবসেবার কাজ। হ্যাঁ, অণুপ্রয়াসের সদস্যরা সকলেই প্রায় চিকিৎসক কিংবা চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়েই পড়াশোনা করছেন তাঁরা। আরমানবাবু নিজেও পঞ্চমবর্ষের ছাত্র। তবে মহামারীর আবহে কাজের চাপ, দায়িত্ব সামলেও রাস্তায় নেমেছেন সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য।
জানা গেল এই সংস্থার শুরু হয়েছিল ২০১৫ সালে। মেডিক্যাল কলেজেই জন্ম নিয়েছিল এই অলাভজনক সংস্থা। আর্থিক পিরামিডের নিচের স্তরে থাকা মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর স্বপ্ন নিয়েই জন্ম নিয়েছিল ‘অণুপ্রয়াস’। সামান্য হাত খরচা থেকে টাকা বাঁচিয়েই চলত সাহায্যের কর্মকাণ্ড। ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে সংস্থা। শক্ত পায়ে ঢাল হয়ে দাঁড়াতে শিখেছে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে।
আরও পড়ুন
দীর্ঘ পথ ঘুরে নামছে বিমান, কেরালায় যাত্রীদের জন্য খাবারে প্যাকেট নিয়ে হাজির স্থানীয়রা
“করোনাকালীন পরিস্থিতিতে আমরা কয়েক হাজার পড়ুয়াকে ত্রাণ বিতরণ করে এসেছি। মাস্ক, স্যানিটাইজার দিয়েছি। এবং তার পরেই ভয়াবহ বন্যা হল আমাদের দেশে জানেনই নিশ্চয়ই। জায়গা-জমি সবই ভেসে গিয়েছিল বন্যায়। চরমে পৌঁছেছিল মানুষের অসহায়তা। সঞ্চয় ছিল না খাদ্যদ্রব্যেরও। সেসময় ৫০০ পরিবারকে আমরা ধান প্রেরণ করে এসেছি”, বলছিলেন অণুপ্রয়াস-সভাপতি।
সম্প্রতি করোনা পরিস্থিতিতে একাধিক স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগ নেওয়াও ‘হিরো অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছে ফরিদপুরের সংস্থাটি। তবে তা নিয়ে খুব কিছু ভাবিত নন আরমানরা। কারণ তাঁদের আসল লক্ষ্যই ছিল মানুষের পাশে দাঁড়ানো। বন্যা হোক কি মহামারী বা আমফান, চরমতম দুর্যোগের দিনগুলোতে সামান্যতম সাহায্য পৌঁছে দিতে পারাকেই সাফল্য বলে মনে করছেন তাঁরা। আশা রাখছেন ছোট করে হলেও নিজেরাই যেন এমন উদ্যোগ নেন বাকিরাও। সমাজের বৈষম্য তো আর মুছে দেওয়া যাবে না একদিনে। তবে কোথাও না কোথাও থেকে তো শুরু করতেই হয় একটা। সেই পথটাই দেখাচ্ছেন অণুপ্রয়াসের সদস্যরা। আর তাঁদের নজিরবিহীন এই উদ্যোগ শেখাচ্ছে খুশি ভাগ করে নিলে কমে না বরং বেড়ে যায় তাতে...
Powered by Froala Editor