মাত্র ১০ বছর আগেই একটি খবর কাঁপিয়ে দিয়েছিল গোটা দেশকে। হরশদ মেহতা ধরা পড়েছেন স্টক মার্কেট স্ক্যামে। সব মিলিয়ে টাকার অঙ্কের সংখ্যা হাজার কোটির ঘর ছাড়িয়েছে। সারা দেশের অর্থনীতি টালমাটাল হয়ে গিয়েছিল সেই সময়। এই ঘটনার ১০ বছর পর, আরও এক ব্যক্তি ধরা পড়লেন কলকাতায়। এবার অভিযোগ, কলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জ তছরুপ করেছেন ইনি। না, হরশদ মেহতার ঘটনার মতো টাকার অঙ্ক ছিল না এখানে। তবে নিছক কমও নয়, প্রায় ১২০ কোটি টাকা! কে এই ব্যক্তি?
সেটা জানার আগে একবার ফিরে দেখা যাক অতীতের দিকে। নবাবের হাত থেকে তখ ক্ষমতা চলে গেছে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে। রাজা-বাদশাহরা তখন তাঁদের হাতের পুতুলমাত্র। এমন সোনার রাজহাঁসের ওপর যখন উপনিবেশ তৈরি করা হবে, তখন সব দিক থেকেই আয়োজন করা ভালো। আর কলকাতা তখন ইংরেজদের স্বপ্নের শহর। এমন সময় ১৮৩০ সালে কলকাতার ভেতরেই একটি নিমগাছের তলায় জড়ো হলেন কয়েকজন। লক্ষ্য লেনদেনের। ইতিহাস বলে, কলকাতা এবং সম্ভবত ভারতেও স্টক এক্সচেঞ্জের ধারণার সূত্রপাত সেই দিনটি থেকেই, সেই নিমগাছের তলায়…
কিন্তু স্টক মার্কেটের সেরকম কোনো স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান তখনও তৈরি হয়নি। এদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিরও ব্যবসা বাড়ছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কলকাতার জৌলুসও বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতেই ১৯০৮ সালে ১৫০ জন মেম্বার নিয়ে শহরের ডালহৌসি অঞ্চলের লায়ন্স রোডে তৈরি হল ‘ক্যালকাটা স্টক এক্সচেঞ্জ’। ভবনটি অবশ্য বড়ো করে তৈরি হয়েছিল ১৯২৮ সালে। উল্লেখ্য, দক্ষিণ এশিয়ায় এর আগে মাত্র একটিই স্টক এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। একরকম ইতিহাসেরই সূত্রপাত হয়েছিল সেই সময়। ধীরে ধীরে ক্যালকাটা স্টক এক্সচেঞ্জও নিজের জায়গা বজায় রাখে। একটি নামী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় এটি।
এবার আসা যাক আসল প্রসঙ্গে। এবং এই পর্যায়ে উপস্থিত হবেন সেই ব্যক্তিটি, যার কথা লেখার শুরুতেই বলা হয়েছিল। তিনি কেতন পারেখ। চ্যাটার্ড অ্যাকাউন্টটেন্ট হিসেবে যাত্রা শুরু হয়েছিল তাঁর। আশির দশকের শেষের দিকে নিজের পারিবারিক ব্যবসায় যুক্ত হয়েই ব্রোকারদের জগতে প্রবেশ করেন। আর এই সময়ই তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় হরশদ মেহতার। এর কয়েক বছর পরই মেহতা ধরা পড়েন স্টক মার্কেট স্ক্যামে। বিশাল অঙ্কের টাকা তছরুপের তথ্য উঠে আসে খবরে। জড়িয়ে পড়ে মেহতার নিজস্ব কোম্পানিও। পরিচিত লোকেদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, এই পুরো কর্মকাণ্ড থেকে বেঁচে যান কেতন পারেখ। তাঁর চেহারা, ভাবভঙ্গি আগে থেকেই ছিল বেশ নরম, ভদ্র ধাঁচের। যাকে বলে মাটিতে পা দিয়ে চলা একজন মানুষ। তার ওপর সিএ; এমন মানুষের ওপর সন্দেহ যে তেমন উঠবে না বলাই বাহুল্য। আর ঠিক এটাই চাইছিলেন কেতন নিজেও…
মেহতার পথ ধরে ততদিনে নিজের ঘুঁটিও সাজানোর পরিকল্পনা শুরু করেছেন তিনি। নব্বইয়ের শেষের দিকে এসে কেতন পারেখের দহরম মহরম বাড়ে। যেখানে হাত দিচ্ছেন, সেখানেই সোনা! স্টক মূল্য নিয়ে রীতিমতো ছেলেখেলা শুরু করেছেন কেতন। আর তাঁর সেই বুদ্ধির ক্যারিশমায় মজে রইল বাকি ব্রোকার ও বিনিয়োগকারীরা। প্রচুর টাকা আসতে লাগল সেই সূত্র থেকে। আর এমন পরিস্থিতিতেই কেতনের যোগাযোগ দৃঢ় হল বলিউডের সঙ্গে। দামি গাড়ি, বাড়ি, বড়ো বড়ো মানুষদের সঙ্গে ওঠাবসা— সবই চলতে লাগল। সবাই অবাক হয়ে দেখল, কেতন পারেখ যাই অনুমান করে তা-ই ঠিক। তিনি তখন স্টক মার্কেটের রাজা!
আর একবার রাজা হয়ে গেলে, হাতে চলে আসে ক্ষমতা। ভেতরে ভেতরে সেই ক্ষমতা অপব্যবহারের ইচ্ছাও চলে আসে। এক্ষেত্রেও অন্যথা হয়নি। মুম্বই থেকে কেতন পারেখের নজর ঘুরল ক্যালকাটা স্টক এক্সচেঞ্জের দিকে। এখানে স্টক এক্সচেঞ্জের সেরকম কঠিন নিয়ম নেই, বেড়াজাল নেই। ব্যস, বেশ কিছু এক্সচেঞ্জের ক্ষেত্রে শুরু হল নিয়ম ভাঙার খেলা। যত ভাঙবে, ততই বাড়তি টাকা। কেতনের সঙ্গে জুড়ে গেল আরও কিছু ব্রোকার। কমিশনের বিনিময়ে চলতে লাগল পুরো কাজ। এর মধ্যে আরও একটা কাজ শুরু করলেন কেতন। পকেটে যখন প্রচুর টাকা আছে, তখন ছোটো ছোটো, অপরিচিত কোম্পানিগুলোর শেয়ার কিনে নাও। রাতারাতি সেই কোম্পানিগুলোর শেয়ার রেটও বেড়ে গেল। একটা জায়গায় পৌঁছনোর পর সব বেচে বেরিয়ে এলেন কেতন পারেখ। নিট ফল? আরও আরও লাভ…
আরও পড়ুন
চুরির টাকায় দরিদ্রদের সাহায্য! হ্যাকার, নাকি হালের ‘রবিনহুড’?
তবে এই কাণ্ডের জেরে কলকাতার অর্থনীতির আঙিনায় এক বিরাট ধস নামল। বড়ো কোম্পানিগুলোর বদলে একেবারে অপরিচিত কোম্পানির শেয়ার মূল্য বেড়ে গেল অনেকটা। ফলে মার্কেটে একটা অদ্ভুত অচলাবস্থা তৈরি হল। যার জের পড়ল শহরবাসীর পকেটে। তবে সবচেয়ে বড়ো ঘটনা এখনও বাকি আছে। ২০০১ সালের মার্চ মাস। সবেমাত্র কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করা হয়েছে। এরপরেই অনেকের নজর থাকে শেয়ার বাজারে। সেই সেনসেক্সেই নামল বিশাল ধস। কেন এমন হল? তদন্তে নামল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া। এবং তখনই সন্দেহের তালিকায় এল কেতন পারেখের নাম। যখন তদন্ত শুরু করেছে আরবিআই, তখন মুম্বইতে চলছে আরও একটি নাটক। সেখানকার বেশ কিছু ব্রোকার পারেখের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। কে-১০ নামের একটি বিশেষ স্টক পারেখের অধীনে ছিল। সেই সঙ্গে ছিল গ্লোবাল ট্রাস্ট ব্যাঙ্ক আর মাধবপুর মারসেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক নামের আরও দুটি প্রতিষ্ঠান। বিপদ বুঝে সেই বিশাল অঙ্কের শেয়ার বেচে দেন তিনি; তাও নির্ধারিত ট্রেডিং সময়ের পর। ফলাফল? পরেরদিনই স্টক মার্কেট পুরোপুরি ভেঙে পড়ে…
এরপর কেতন পারেখের ধরা পড়া ছিল কেবল সময়ের অপেক্ষা। ২০০২ সালে কলকাতা পুলিশের বিশেষ টিম তাঁকে গ্রেফতার করে। তখনই সামনে আসে ২০০১ সালে প্রায় ১২০ কোটি টাকা তছরুপের অঙ্ক। গোটা ভারতে রীতিমতো আলোড়ন পড়ে যায়। স্রেফ নিজের বুদ্ধিকে অদ্ভুতভাবে, ভুল পথে কাজে লাগালেন কেতন পারেখ। আর সেই ফাঁদে পা দিয়েছিলেন আরও বহু ব্রোকার ও বিনিয়োগকারী। বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে গোটা দেশের স্টক মার্কেটকে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছিলেন তিনি। ব্যাঙ্কিং সিস্টেমকেও ছাড়েননি পারেখ। ঐতিহাসিক ক্যালকাটা স্টক এক্সচেঞ্জকেও নিজের পথের হাতিয়ার করেছিলেন। হাতিয়ার, না রঙ্গমঞ্চ? গ্রেফতারির সময় সবার নিশ্চয়ই ১০ বছর আগের কাহিনিটাও মনে পড়েছিল। মনে পড়েছিল হরশদ মেহতার কথা। কেতন পারেখের যাত্রাও তো সেই সময় থেকেই…
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
১৪ বছর পর উদ্ধার চুরি-যাওয়া মানিব্যাগ, টাকা এবং গুরুত্বপূর্ণ নথি-সহ ফেরাল জিআরপিএফ