কিছুদিন হল বর্ষার শেষে নতুন ফসল উঠেছে কেরালায়। আর সেই আনন্দে মেতে উঠেছেন সকলে। বাড়িতে বাড়িতে ফুলের কার্পেটে সেজে উঠছে গ্রামগুলি। নতুন ফসলের খাবার কলাপাতার উপর সাজিয়ে চলছে প্রতিদিনের খাওয়াদাওয়া। আর নৃত্যগীতের আয়োজন তো আছেই। ঠিক আমাদের নবান্নে যেমন হয়। তবে কেরালায় এই অনুষ্ঠান একদিনে নয়, চলে টানা ১০ দিন। আর সেই উৎসবের নাম ‘ওনাম’। ওনাম উৎসবের সবচেয়ে বড়ো আকর্ষণ অবশ্য নৌবাইচের খেলা এবং হাতির শোভাযাত্রা। প্রাণী সুরক্ষা আইনের কারণে অবশ্য হাতির শোভাযাত্রা এখন অনেক কমে এসেছে। তবে তাতে উৎসবের মেজাজে খামতি পড়েনি কোথাও। এবছরও আগস্ট ২২ থেকে শুরু হয়েছে ওনাম।
ওনাম উৎসবের সময় থেকেই শুরু হয় মালয়ালম ক্যালেন্ডারের নববর্ষ। বাংলাতেও এক সময় নবান্নের মাস অগ্রহায়ণ থেকেই শুরু হত বছর। সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে ওনাম উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক পৌরাণিক কাহিনিও। আর সেই কাহিনি আমাদের মোটামুটি জানা।
অসুরদের মধ্যে ছিলেন এক মহা শক্তিশালী রাজা। তাঁর নাম মহাবলি। তাঁর রাজত্ব ছিল অসুরকূলের সোনার যুগ। তাঁর প্রতিপত্তি দেখে ভয় পেয়েছিলেন স্বর্গের দেবতারাও। বিশেষ করে মহারাজা বলি যেহেতু কোনোধরণের বৈষম্যই মানতেন না, তাই দেবতাদের সম্মান জানানোর কথাও তিনি ভাবতেন না। আর তাই মহাবলিকে শায়েস্তা করার জন্য দেবতারা বিষ্ণুর স্মরণাপন্ন হলেন। বিষ্ণু সব শুনে এক পরিকল্পনা নিলেন। প্রবল পরাক্রমী বলির সঙ্গে যুদ্ধে তিনি পারবেন না। তাই এক ছলনার আশ্রয় নিলেন। বলি যখন ভোরের স্নান সেরে নদী থেকে উঠে আসছেন তখন তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল এক বামন ব্রাহ্মণ। বামনকে দেখে ভারি মায়া হল বলির। তিনি প্রার্থনা নিবেদন করতে বললেন। বামন জানালেন, তাঁর থাকার কোনো জায়গা নেই। তিনি একটু জমি চান। বলি করুণায় বিগলিত হয়ে বললেন, তিনি যতটা জমি চান, ততটাই দেওয়া হবে। বামন বললেন, বেশি না, তাঁর তিনটি পদক্ষেপের সমান জায়গা লাগবে।
বামনের নিবেদনে প্রতিশ্রুত হলেন মহাবলি। আর ঠিক তখনই বিষ্ণুর অবতার তাঁর নিজের চেহারায় ফিরে এলেন। একটি পা রাখল স্থলভাগে, অন্যটি জলভাগে। তৃতীয় পা যখন তিনি তুলে ধরেছেন তখন সমগ্র জগতকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে মাথা পেতে দিলেন মহাবলি। আর বামন অবতার তাঁর পায়ের চাপে বলিকে পাঠিয়ে দিলেন পাতালে।
আরও পড়ুন
রমজান মাস জুড়ে আলোর উৎসব, অভিনব উদযাপনের সাক্ষী আমেরিকা
ওনাম উৎসব এই কাহিনিকে স্মরণ করে। না, বামন দেবতার সাফল্যকে নয়। কারণ মালয়ালি সম্প্রদায়ের মানুষরা বিশ্বাস করেন, তাঁরা মহাবলির উত্তরপুরুষ। তাঁদের মহান রাজাকে পাতালে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বামন অবতার। কিন্তু বছরে ১০ দিন পাতাল লোক থেকে ফিরে আসার অনুমতি পান তিনি। আর এই ১০ দিন ধরেই চলে ওনাম উৎসব। প্রিয় রাজাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে মেতে ওঠেন সবাই।
সমস্ত পৃথিবীতেই দেখা যায় জয়ীকে স্মরণ করেই যত উৎসবের আয়োজন। আমরা রামের লঙ্কা বিজয় স্মরণ করি, দুর্গার অসুরবিজয় স্মরণ করি, স্মরণ করি মহাভারতে পাণ্ডবদের বিজয়ও। কিন্তু এর মধ্যেও বেশ কিছু ব্যতিক্রম চোখে পড়ে এই দেশে। ঠিক তেমনই এক ব্যতিক্রম ওনাম উৎসব। শুধুই ওনাম নয়, একটু খুঁজলেই দেখা যাবে দক্ষিণ ভারতে এখনও আছে বেশ কিছু রাবণের মন্দির আজও টিকে আছে। অযত্নে, অবহেলায় তার চেহারা মলিন হয়ে এসেছে। কিন্তু বহু মানুষ আজও রাবণকে তাঁদের মহান রাজার সম্মান দেন। বাংলা-বিহারের অনেক আদিবাসী সম্প্রদায় এখনও দুর্গাপুজোর সময় নিজেদের বেদনা প্রকাশ করেন। দুর্গা নয়, মহিসাসুরই তাঁদের আপনজন।
আরও পড়ুন
এই প্রথম রক্তহীন অযোধ্যা, বুদ্ধ পূর্ণিমায় বন্ধ রইল ‘শিকার উৎসব’
আজকাল অবশ্য সমগ্র ভারতের এই বিরাট বৈচিত্রময় সংস্কৃতিকে মুছে ফেলার এক কর্মযজ্ঞও শুরু হয়ে গিয়েছে। হিন্দুত্বের বাইরে যে আছে এদেশের এক বিপুল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, তাকেই যেন অস্বীকার করার চেষ্টা চলছে। আর তার সূত্র ধরেই অনেকে ওনাম উৎসবের তাৎপর্যকেও বিকৃত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মহাবলিকে নয়, তাঁরা চান বামন অবতারকে স্মরণ করেই অনুষ্ঠিত হোক ওনাম উৎসব। কিন্তু এই সব পরিকল্পনার মধ্যে আজও নিশ্চিন্তে এগিয়ে চলেছে এই আনন্দের স্রোত। এই উৎসবের আয়োজনের মধ্যেই যে আছে আর্য-অনার্যের দীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাস। ইতিহাস মুছে ফেলা কি অতোই সহজ?
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
দই-চিঁড়ে উৎসব শুরু করেছিলেন নিত্যানন্দ, ‘হাজির’ চৈতন্যও, তাঁরাও বাংলাদেশি?