কেরলের (Kerala) কোল্লাম জেলার পল্লীমুক্কু শহর। সে-শহরের বুক চিরে চলে গেছে ৬৬ নম্বর জাতীয় সড়ক। তার দু’পাশে অসংখ্য ছোটো ছোটো চা-জলখাবারের দোকান। যেরকমটা দেখা যায় যেকোনো অফিস পাড়ায়। তবে এই দোকানের ভিড়ের মধ্যেই চোখ আটকে যেতে বাধ্য একটি সাইনবোর্ডে। সাদার ওপরে কালো রঙের কালিতে ফুটে উঠেছে ‘বিটেক চায়ে— আ চায়ে উইথ লজিক (BTech Chai— A Chai With Logic)।’ চা, তাও আবার বিটেক!
নামটা শুনেই অদ্ভুত লাগার কথা। আরও অদ্ভুত লাগবে ছোট্ট, ত্রিপল ও টিনের ছাউনি দেওয়া, অতিসাধারণ এই দোকানের ভেতরে ঢুকে পড়লে। মেনুকার্ড দেখলে কপালে উঠবে চোখ। কম করে হলেও সেই ঠেলাগাড়িতে পাওয়া যাবে অন্ততপক্ষে ১০০টি ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের চায়ের ‘পদ’। আর দোকানের নামের রহস্য?
সেই গল্পেই ফেরা যাক বরং। বছর দুয়েক আগের কথা। মহামারী ঠেকাতে ২০২০ সালের মার্চ মাসে গোটা দেশজুড়ে নেমে এসেছিল লকডাউনের ছায়া। এক ঝটকায় বদলে গিয়েছিল মানুষের স্বাভাবিক যাপনচিত্র। স্কুল, কলেজ, অফিসের দরজায় তালা পড়ায় বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা কিংবা কাজ করতে হচ্ছিল সাধারণ মানুষকে। কিন্তু এটাই তো আর সামগ্রিক চিত্র নয়। হঠাৎ পরিস্থিতির এই রদবদলে কাজ হারিয়েছিলেন অসংখ্য মানুষ।
আনন্দু অজয়, মহম্মদ শাফি এবং মহম্মদ শাহনাভাস— অনেকের মতোই কাজ হারিয়েছিলেন কেরলের এই তিন বিটেক গ্র্যাজুয়েট ইঞ্জিনিয়ারও। বলতে গেলে সবচেয়ে বেশি প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল শাহনাভাসকে। মধ্যপ্রাচ্যে হঠাৎ করে উপার্জনহীন হয়ে পড়া কতটা চ্যালেঞ্জিং, তা না বললেও চলে। সেইসঙ্গে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল দেশে ফেরার পথও।
আরও পড়ুন
দার্জিলিং: চায়ের গল্প, নানা রকমের শ্রম ও নিসর্গ
লকডাউন চলাকালীন সময় থেকেই তাই বিকল্প উপার্জনের সন্ধান শুরু করেন কেরলের তিন ইঞ্জিনিয়ার। প্রাথমিকভাবে ঠিক হয় রেস্তোরাঁ খোলার কথা। কিন্তু তার জন্য আলাদা জায়গা লাগবে, লাগবে আলাদা রাঁধুনিও। সেইসঙ্গে বড়ো অঙ্কের পুঁজি তো আছেই। সবদিক চিন্তা করেই তাই ঠেলাগাড়িকেই বেছে নেন তিন বন্ধু। ফুটপাথের ধারে জায়গা পেতেও খুব একটা লড়াই করতে হয়নি তাঁদের।
আরও পড়ুন
লড়াকু বাবার পাশে অভিনেত্রী মেয়ে, 'উপহার' দিলেন চায়ের দোকান
তবে একদমই কি লড়াই করতে হয়নি এই দোকানের জন্য? হ্যাঁ, হয়েছিল। আর সেই বাধা এসেছিল নিজেদের পরিবারের থেকে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার পর চায়ের দোকান দেবে সন্তান— এমনটা কোন বাবা-মাই বা মেনে নিতে পারেন? ফলে পরিবারের থেকে কোনোরকম আর্থক সহায়তাই পাননি তিন তরুণ। বন্ধুদের থেকে কোনো মতে জোগাড় করা সম্ভব হয়েছিল লাখ দেড়েক টাকা। তা দিয়েই শুরু হয় পথচলা। তবে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি সাফল্যের জন্য। চালু হওয়ার মাত্র একমাসের মধ্যেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা আদায় করে নেয় ‘বিটেক চায়ে’।
আরও পড়ুন
চায়ের দোকান খুলেই ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন বুনছেন ‘চা-কাকু’ মৃদুল দেব
শুরুতে প্রায় ৫০ ধরনের চা মিলত কেরলের এই টি-স্টলে। আজ বাড়তে বাড়তে মেনুকার্ডে সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ১০২-তে। দৈনন্দিনের বাঁধাধরা গ্রাহকরা তো আছেনই, সেইসঙ্গে পথচলতি মানুষ এবং পর্যটকরাও রীতিমতো ভিড় জমান ‘বিটেক চায়ে’-তে। কেরলের এই তিন ইঞ্জিনিয়ারের উদ্যোগ যেন মনে করিয়ে দেয় হাবড়া স্টেশনের ‘এমএ ইংলিশ চায়েওয়ালি’-র কথা…
Powered by Froala Editor