ছয় দশক পেরিয়েও রাজত্ব ধরে রেখেছে বাঙালির ব্র্যান্ড ‘কিও কার্পিন’

বাংলার বিখ্যাত ব্যান্ড চন্দ্রবিন্দু তাদের গানে বলেছিল, “ত্বকের যত্ন নিন”। কিন্তু শুধুই কি ত্বক? শরীরের বাকি অংশেরও তো যত্ন নিতে হবে। আর সেখানে যদি প্রসঙ্গ আসে চুলের, তাহলে তো কথাই নেই। চুলের আছে নানা বাহার, নানা কারুকার্য। সুতরাং হওয়া উচিত ছিল, ত্বকের সঙ্গে চুলেরও যত্ন নিন।

চুল বলতেই সামনে আসে তেলের কথা। আজকের বাজারে এত রকম তেলের ছড়াছড়ি, ক্রেতা প্রথমেই দিশা হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু এই ভিড়ের মধ্যে এখনও একটি তেল চোখে পড়ে। নয় নয় করে তার ৬৩ বছর বয়স হয়ে গেল। বয়স হলে কী হবে, জনপ্রিয়তায় এখনও বাংলার প্রথম সারির অন্যতম তেলের ব্র্যান্ড। এত হেঁয়ালির কিছু নেই, তাকে আমরা প্রত্যেকেই চিনি এক ডাকে। সে আমাদের প্রাণের কিও কার্পিন।

‘দ্য ফর্মুলা দ্যাট ইন্ডিয়া ডিসকভারড সেঞ্চুরিস অ্যাগো’— একদম শুরুর দিকে কিও কার্পিনের বিজ্ঞাপনে এমনই লেখা থাকত। ভেষজ পদ্ধতিতে, যতটা সম্ভব রাসায়নিক ছাড়া তেল তৈরি করা— এটাই উদ্দেশ্য ছিল এর। আর কিও কার্পিনের কথা বলতে গেলে অবধারিত চলে আসবে দে’জ মেডিক্যালের কথা। বাংলার যে কোম্পানি একটা সময় এনেছিল এই প্রোডাক্ট, দেশীয় ব্যবসাকে আরও মজবুত ও স্বনির্ভর করতে।

এ যেন আরেক ভারত গড়ার কাজ। তবে আজকের নয়, অনেক আগের। গান্ধীজির স্বদেশি আন্দোলন দিয়ে যার সূত্রপাত। আমাদের বাংলায় যে ধারাই বহন করেছিল বেঙ্গল কেমিক্যাল, জি ডি ফার্মাসিউটিকলস। পরবর্তীতে, ১৯৪১ সালে এল দে’জ মেডিক্যাল। সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধে আহত সেনাদের জন্য যাবতীয় ওষুধ তোলা হয়েছিল দোকান থেকে। কলকাতার এক ছোট্ট দোকান থেকে বি.এন. দে সাধারণের জন্য ওষুধ বিলি করা শুরু করলেন। এভাবেই শুরু হয় দে’জ মেডিক্যালের পথ চলা। এরও ১৫ বছর পর, ১৯৫৬ সালে তাঁরা নিয়ে আসেন নিজস্ব প্রোডাক্ট। সম্পূর্ণ ভেষজ পদ্ধতিতে তৈরি তেল। নাম দেওয়া হয় ‘কিও কার্পিন’।

আরও পড়ুন
https://prohor.in/a-story-of-legendary-antiseptic-cream-boroline/

হ্যাঁ, সেই থেকেই শুরু ইতিহাসের। প্রকাশের পর থেকেই বিক্রি বাড়তে থাকে। বলা যেতে পারে, মাথার তেলের দুনিয়ায় একটা বদল আনে কিও কার্পিন। কারণ এর আগে ভাল স্বাস্থ্যকর তেল বলতে ঘন তেলগুলি ব্যবহৃত হত। কিও কার্পিনের মতো হালকা তেল সেই ধারণায় একটা আঘাত হানল বলা যায়। সেই সঙ্গে বিজ্ঞাপনেও আনল বৈচিত্র্য। তখনকার নতুন প্রজন্ম ধীরে ধীরে আগেকার ঘন তেলকে ত্যাগ করতে আরম্ভ করল। দেখতে দেখতে বাজারে রাজত্ব করতে শুরু করল এটি। ১৯৮৯ সালেই তাঁরা ২০ কোটি টাকার লাভের মুখ দেখল। তৈরি হল ব্র্যান্ড ‘কিও কার্পিন’-এর।

কিন্তু, নব্বইয়ের দশকেই খানিক অবস্থা পড়ে যায় কিও কার্পিনের। সেই সময় দে’জ মেডিক্যাল ব্র্যান্ড কিও কার্পিনের আরও দুটো প্রোডাক্ট বের করে। হেয়ার ভাইটালাইজার এবং স্কিন কেয়ার। সময়টা নব্বইয়ের শেষের দিক। আবারও ঘুরে দাঁড়াল কিও কার্পিন। তারপর ফিরে তাকাতে হয়নি ‘জুয়েল অফ দ্য ইস্ট’-এর। আরও নতুন নতুন প্রোডাক্ট বের তো হলই, ব্যবসাতেও নয়া জোয়ার এল। জোয়ার এল বিজ্ঞাপনেও। রিয়্যালিটি শো থেকে খেলা, টিভির পর্দা সমস্ত জায়গায় দেখা গেল কিও কার্পিনকে। দেখা গেল দে’জ মেডিক্যালকে। সম্মানও এল অনেক। ২০১৫ সালে ভারতের ‘মোস্ট ট্রাস্টেড হেয়ার অয়েল ব্র্যান্ড’ হিসেবে সম্মানিত হয় এটি। বেশ কয়েকবার সুপারব্র্যান্ডের তকমাও পেয়েছে।

বাঙালিদের তৈরি এই ব্র্যান্ড হয়তো ব্যবহার করেছেন অনেকেই। ভেবে দেখুন তো, ৬৩ পেরিয়েও এর জনপ্রিয়তা দেখে আপনারও কি গর্ব হয় না বাঙালি হিসেবে?