বাঙালির সকাল এক কাপ চা আর খবরের কাগজ ছাড়া শুরু হচ্ছে, এটা ভাবা যায় কখনও? লকডাউন বলুন বা অফিসের ব্যস্ত সময়, মনটা কি কখনও চা-চা করে ওঠেনি? আর চা যখন আছে তখন সঙ্গে ‘টা’ও তো থাকবে। পাড়ার মোড়ের টিনের চালের দোকান হোক, বা স্টেশন, বা নিজের ঘর, এই ‘টা’-এর জায়গা নিয়ে বসে আছে বিস্কুট। হরেকরকম নাম, হরেকরকম স্বাদ। বিশ্ব তো বটেই, ভারতেও রাজত্ব করছে বহু সংস্থা। এই বিস্কুটের রাজত্বেই ধ্বজা তুলেছিলেন কৃষ্ণদাস পাল। সংক্ষেপে কে ডি পাল। তাঁর সংস্থার নাম এখন পাড়ার মোড়ে মোড়ে। বাংলা তো বটেই, গোটা ভারত তাঁর তৈরি করা বিস্কুটে মজে আছে। কৃষ্ণদাস পাল আর বিস্কফার্ম আজ সমার্থক শব্দ হয়ে গেছে। গত সোমবার রাতে ৭৮ বছর বয়সে মারা গেলেন তিনি। শোকের ছায়া বাঙালি শিল্পমহলে। কৃষ্ণদাসের ছেলে অর্পণ পাল এখন হাল ধরেছেন কোম্পানির…
বর্ধমানের গ্রামের ছেলে কলকাতায় চলে এল বাবা মায়ের হাত ধরে। তারপর এই শহরের বুকেই শুরু হল তাঁদের জীবন সংগ্রাম। এমন কাহিনি সেই কবে থেকে দেখে আসছে তিলোত্তমা। কৃষ্ণদাস পালের গল্পটাও শুরু হয় এরকমভাবেই। তাঁর বাবাও গ্রাম থেকে কলকাতায় এসে সামান্য ব্যবসা শুরু করেছিলেন, ট্রেডিং আর ডিস্ট্রিবিউশনের। সামান্য রোজগারের সংসারেই বড়ো হচ্ছিলেন কৃষ্ণদাস। কখনও বাড়ি বাড়ি দুধ পৌঁছে দিয়ে, কখনও বাবাকে ব্যবসার কাজে সাহায্য করে চলত সবটা। সেইসঙ্গে চলল পড়াশোনা। বেশ ভালোই ছিলেন পড়াশোনায়। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে সাহিত্য ও আইনের আঙিনায় ঢুকলেন। ব্যবসা তখনও তাঁর কাজের জগতে আসেনি। তখন শিক্ষকতা আর ওকালতিই ছিল তাঁর নিজের জায়গা। সেখানেই হয়তো থেকে যেতেন, যদি না বাবা পূর্ণচন্দ্র তাঁকে ব্যবসার দিকে টেনে আনতেন।
এদিকে বাবার ব্যবসা ভাগ হয়ে গেল তিন ভাইয়ের মধ্যে। কৃষ্ণদাস পেলেন ডিস্ট্রিবিউশন। তখন থেকেই যোগাযোগ এই বিশাল মার্কেটের সঙ্গে। নেসলে, ল্যাকমি আর ক্যালকাটা কেমিক্যালস— এই তিনটে কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা তো ছিলই। পরে কৃষ্ণদাস প্রায় একার চেষ্টাতেই সেই তালিকায় যুক্ত করলেন ব্রিটানিয়া, ডাবর, হরলিক্সের মতো কোম্পানিকে। ব্যবসা ও লাভের পরিমাণ এক ধাক্কায় বেড়ে গেল অনেকটা। এখানেই হয়তো থেকে যেতে পারতেন। কিন্তু জীবন তো অনিশ্চিত। তার বাঁকে বাঁকে আশ্চর্য সব ঘটনা। কৃষ্ণদাস থেকে কে ডি হবার যাত্রা সেই বাঁকেরই ছবি দেখায়।
ক্যালকাটা কেমিক্যালসের ডিরেক্টর সমরেশ দাশগুপ্ত এই সময় মারা গেলে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে সেই কোম্পানির শেয়ার কিনে নেন কৃষ্ণদাস। কিন্তু উল্টোদিকে এগিয়ে এল আরেক প্রতিপক্ষ, শ ওয়ালেস। এমন ঘটনায় অসন্তুষ্ট হলেন কে ডি। আর সেই ঝড়ই গড়াল আদালত পর্যন্ত। বিস্তর ঘটনাপ্রবাহের পর তাঁর শেয়ার বিক্রি করে দিলেন কে ডি। কিন্তু ক্ষতিপূরণ পেলেন প্রায় ৭ কোটি টাকা। আর এই টাকা দিয়েই ২০০০ সালে শুরু হল ‘সাজ ফুড প্রোডাক্টস প্রাইভেট লিমিটেড’। যে কোম্পানির প্রধান প্রোডাক্ট হল ‘বিস্কফার্ম বিস্কুট’। আজকের সেই বিস্কফার্মের জন্ম হল এভাবেই। প্রথমে উলুবেড়িয়া, তারপর শিলিগুড়ি— কারখানা বেড়েই চলল। সেইসঙ্গে বেড়ে চলল বিস্কফার্মের নাম। আর আজ? ২০ বছর বয়সী এই কোম্পানি গোটা ভারতে বেকারি ব্যবসায় চতুর্থ স্থান অধিকার করে আছে। আগে আছে ব্রিটানিয়া, পার্লে আর আইটিসি। শুধু বিস্কুট নয়, কুকিজ, কেক-সহ নানা জিনিস তৈরি করা হয় এখানে। তৈরি হয়েছে ‘জাস্ট বেকড’ও, যেখানে বসে গল্প করতে করতে নিজের পছন্দমতো খাবার খেতে পারবেন।
আজ রাজ্যের বাইরেও বিস্কফার্ম পা রেখেছে। বছরে ব্যবসা থেকে আসে কয়েকশো কোটি টাকা। কিন্তু তাও মাটিকে ভুলে যাননি কে ডি, ওরফে কৃষ্ণদাস পাল। ব্যবসাতে তিনি প্রয়োগ করেছেন উদ্ভাবনী ক্ষমতার। নিত্য নতুন প্রোডাক্টের বৈচিত্র্যই তাঁর ইউএসপি। কিন্তু সেখানেই থেমে থাকেননি তিনি। মানুষের অসুবিধার সময় পৌঁছে গেছেন তাঁদের কাছে। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে বর্ধমানে নিজের গ্রামে রাস্তা তৈরি, বিদ্যুৎ নিয়ে আসা— সবই করছেন তিনি। তবে বাঙালি নাকি ব্যবসা করতে পারে না— এমন কথার জবাব তিনি নিজের কাজের মধ্যে দিয়েই তৈরি করে দেখিয়েছেন। নিজেই হয়ে উঠেছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান।
ঋণ – অরবিন্দ ঘোষ, স্বপন সেন
আরও পড়ুন
পিতৃতন্ত্রের গোড়ায় আঘাত পাঞ্জাবের ব্যবসায়ীর, জন্ম নিল 'গুপ্তা অ্যান্ড ডটার্স'
Powered by Froala Editor