"হঠাৎ করে বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে গেল মাথা
শিক্ষা হল কালকে থেকে সঙ্গে নেব ছাতা"…
শহরে বর্ষা ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই এমন শিক্ষা অনেকের হয়েছে। অতএব কেউ ঘরে ফিরে পুরনো তোরঙ্গ খুলে বসেছেন, কেউ ছুটেছেন দোকানে। কেউ কেউ অবশ্য গ্রীষ্মকাল থেকেই প্রস্তুত। আরে বাবা, ‘গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষা, কে. সি. পালই ভরসা’। হ্যাঁ, বাঙালির কাছে ছাতা মানেই তো কে. সি. পাল। দেখতে দেখতে ৮০ ছুঁতে চলল বড়বাজারের সেই দোকান। আর এখন ডালপালা মেলে পরিধিও বেড়েছে অনেকটাই। মাথার উপর এমন একটা ছায়া থাকলে আর চিন্তা কীসের?
অবশ্য ১৯৪২ সালে যখন কে. সি. পালের ছাতার ব্যবসা শুরু হল, তখন বাঙালি রোদ কিংবা বৃষ্টি নিয়ে চিন্তিত ছিল না। বাঙালির মাথার উপরে তখন পড়ছিল বোমা। নেতাজি তখন সিঙ্গাপুরে, জাপানে রাসবিহারী বসু তাঁর জন্য অপেক্ষা করছেন। আর শ্যামবাজার, খিদিরপুরে ঝাঁকে ঝাঁকে পড়ছে জাপানি বোমা। আবার স্বাধীনতা আন্দোলনের নতুন নতুন মোড় দেখা যাচ্ছে। ব্রিটিশদের তাড়াতে না পারলে তো এই যুদ্ধের হাত থেকেও নিস্তার নেই। নিতান্তই ভয়ে কাবু যাঁরা, তাঁরা তখন নৌকোয় উঠে ফিরে যাচ্ছেন গ্রামের দিকে। কলকাতায় থাকা আর সম্ভব নয়। কিন্তু তুলসীদাস পালের ছাতার ব্যবসা ছেড়ে যেতে পারলেন না ছেলে কার্তিকচন্দ্র পাল। বরং সেই ব্যবসাকেই আরও খানিকটা বাড়ানোর চেষ্টা করলেন তিনি। এভাবেই বড়বাজার পুরুষোত্তম রায় স্ট্রিটে তৈরি হল প্রথম দোকানটি।
৫ বছরের মধ্যে আরেকটি দোকান তৈরি হল হ্যারিসন রোড, অর্থাৎ আজকের মহাত্মা গান্ধী রোডে। দেশ তখন স্বাধীনতার স্বপ্নে মশগুল। আর এই সময়ে দেশীয় শিল্পের চাহিদা যে বাড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু ব্যবসা ফুলে ফেঁপে ওঠা দেখে যেতে পারলেন না কার্তিকচন্দ্র ওরফে কে. সি. পাল। ১৯৪৭ সালে মাত্র ৫২ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হল। ব্যবসার হাল ধরলেন দুই ছেলে অনাথনাথ এবং বিশ্বনাথ। বাকি দুই ছেলে অলোকনাথ এবং দেবনাথ তখন রীতিমতো ছোটো। তবে অনাথনাথ ছিলেন ব্যবসার ব্যাপারে অত্যন্ত সিরিয়াস। সেই ২৪ বছর বয়স থেকেই সারা দেশ ঘুরে বেড়াতেন তিনি। এদেশে অনাথনাথের নামের সঙ্গে পরিচয় নেই, এমন ছাতার ব্যবসায়ী পাওয়া মুশকিল।
এভাবেই 'কে. সি. পাল অ্যান্ড সন্স' নিজেই হয়ে উঠল একটি ট্রেডমার্ক। নামের উপরে সরকারি আর চিহ্নের দিকে না তাকিয়েই বাঙালি নিশ্চিন্তে ভরসা রেখেছে। ওই যে নিচে লেখা, 'সিন্স ১৯৪২', ওটুকুই যথেষ্ট। রোদ, ঝড় অথবা বৃষ্টিতে একান্ত বন্ধুর মতো। কখনো কখনো তাকে দেখা যায় বৃদ্ধের লাঠি হয়েও। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিকতার ছোঁয়াও লেগেছে। তিন ফোল্ডের ছাতা অনায়াসে ঢুকে যায় আধুনিকার ভ্যানিটি ব্যাগের মধ্যে। আজকাল ছাতার পাশাপাশি বর্ষাতির ব্যবসাতেও বাজার দখল করেছে কে. সি. পাল। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার উড়িষ্যা ছাড়িয়ে ব্যবসা ছড়াচ্ছে আসাম এবং ত্রিপুরাতেও। কে. সি. পালের নাতিরা হয়তো আসমুদ্র হিমাচলকেই তাঁদের ছাতার তলায় নিয়ে আসতে চান।
তবে অসংখ্য মানুষের মাথার ছাতা ধরে আছে যে পরিবার, তার মাথার ছাদটাও একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে। ব্যবসার ভাগাভাগি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু চার নাতি এখনও একসঙ্গেই থাকেন চিত্তরঞ্জন অ্যাভেনিউর সাবেক গড়নের 'তুলসী ভবন'এর মধ্যেই। সেইসঙ্গে দুটি দোকানের ১০ জন কর্মচারী এবং সিমলা অঞ্চলের কারখানার ৪০ জন কর্মী, সবাইকে নিয়েই কে. সি. পালের পরিবার। গড়ে প্রতিদিন ২০ ডজন ছাতার যোগান দিয়ে চলেছেন তাঁরা।
তবে সাইকেলের মতোই ছাতা তৈরির সরঞ্জামও এদেশের কোনো কোম্পানিই বানায় না। কে. সি. পাল অ্যান্ড সন্স ছাতার কাপড়, রিবস এবং বাঁট আমদানি করে তাইওয়ান থেকে। বর্তমানে কারখানার মালিক রঞ্জন পালের কথায়, সবকিছু বানাতে গেলে একটি কারখানায় হবে না। অন্তত চারটি কারখানা প্রয়োজন। তবে সেই পরিকল্পনাও যে নেই, তেমনটা নয়। কে. সি. পালের ছাতার সঙ্গে যেমন ৭৮ বছরের ফেলে আসা ইতিহাস জড়িয়ে আছে, তেমনই আছে এগিয়ে চলার স্বপ্নও। শুধুই বাঙালি নয়, হয়তো একদিন সারা ভারতে বিভিন্ন ভাষায় মানুষ বলবে, ‘গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষা, কে. সি. পালই ভরসা’।
আরও পড়ুন
বয়স ৫০ ছুঁইছুঁই, বাঙালির খাদ্যতালিকায় আজও অপ্রতিরোধ্য সস্তার বাপুজি কেক
তথ্যসূত্রঃ ছাতা ভাগ হয়েছে, ভাগ হয়নি কে. সি. পালের নাতিদের ছাদ, তাপস গঙ্গোপাধ্যায়, আজকাল
Powered by Froala Editor