পেপারব্যাক বই-এর থেকে হার্ডবাউন্ড বই-এর দাম বেশ খানিকটা বেশি। বইপোকাদের কাছে এই তথ্য একেবারেই অজানা নয়। আর সেই বই যদি চামড়ায় বাঁধানো হয় তবে তো কথাই নেই। পেপারব্যাক-ইবুকের যুগেও এহেন বই ব্যক্তিগত সংগ্রহে সামিল করা রীতিমতো শ্লাঘার ব্যাপার যে-কারোর কাছেই। কিন্তু সেই বই যদি মানুষের চামড়ায় (Human Skin) বাঁধানো হয়? এক মুহূর্তের জন্যে হলেও কেঁপে উঠবে বুক।
কাজাখস্তানের রাজধানী আস্তানায় সম্প্রতি শুরু হল এমনই এক আশ্চর্য গ্রন্থের প্রদর্শনী। সে-দেশের ন্যাশনাল অ্যাকাডেমিক লাইব্রেরির ‘রেয়ার পাবলিকেশন মিউজিয়াম’-এ প্রায় ৮ বছর ধরে বন্দি থাকার পর এবার প্রকাশ্যে এল মানুষের চামড়ায় বাঁধানো এই প্রাচীন বই।
গবেষণা অনুযায়ী, এই গ্রন্থের বয়স প্রায় ৫০০ বছর। আনুমানিক ১৫৩২ সালে এই পাণ্ডুলিপিটি রচনা করেছিলেন ইতালির পেত্রাস পুয়ার্দেস নামের এক নোটারি। তবে ইতালীয় ভাষায় নয়, বরং ল্যাটিন হরফে ভিন্ন এক সাংকেতিক ভাষায় লেখা হয়েছিল এই গ্রন্থ। ফলে, এত বছর পরেও সম্পূর্ণভাবে পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়নি এই গ্রন্থের। ৩৩০ পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপির মধ্যে মাত্র ১০টি পাতার বিষয়বস্তুকেই এখনও পর্যন্ত ডিকোড করতে সক্ষম হয়েছেন গবেষকরা। সংশ্লিষ্ট অংশের বিষয়বস্তু থেকে ধারণা করা হয়, ঋণ প্রদান, বন্ধক, আর্থিক লেনদেনের মতো অর্থনৈতিক বিষয়েই লেখা হয়েছিল এই গ্রন্থ। কিন্তু সেটাই যদি হয়ে থাকে তবে এমন দুর্বোধ্য সাংকেতিক ভাষায় কেন লেখার প্রয়োজন পড়ল এই গ্রন্থের, তা আজও অস্পষ্ট গবেষকদের কাছে।
এখানেই শেষ নয়, রহস্য লুকিয়ে রয়েছে এই গ্রন্থের প্রচ্ছদ, থুড়ি মলাটেও। সাধারণত মানুষের চামড়ায় বই বাঁধানোর রীতি শুরু হয়েছিল সপ্তদশ থেকে অষ্টদশ শতকে। অর্থাৎ, একদিকে যখন সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে শুরু হচ্ছে লড়াই, সে-সময়ই ফ্রান্স ও ইতালিতে শুরু হয় চামড়া দিয়ে বই বাঁধানোর রীতি। এও কথিত আছে ফরাসি বিপ্লবের সময় বাস্তিল দুর্গের নিকটেই তৈরি হয়েছিল মানুষের চামড়া প্রক্রিয়াকরণের জন্য বিশেষ ট্যানারি। অন্যদিকে হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ডের পর তার চামড়া দিয়ে বাঁধানো হয়েছে বই— এমন উদাহরণ পাওয়া যায় ব্রিটেনেও।
উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে ইতিহাসের এই অন্ধকার অধ্যায় মুছে ফেলতে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল মানুষের চামড়ায় বাঁধানো অধিকাংশ বই। কিছু বই প্রাথমিকভাবে সংরক্ষণ করা হলেও, নষ্ট হয়ে যায় দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধের সময়। ফলে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে গোটা বিশ্বে মানুষের চামড়ায় বাঁধানো বই-এর সংখ্যা সবমিলিয়ে মাত্র ৫০টি। তার মধ্যে কেবলমাত্র ১৮টি গ্রন্থের ক্ষেত্রে পরীক্ষাগতভাবে গবেষকরা নিশ্চিত করেছেন তা মানুষের চামড়ায় বাঁধানো। উল্লেখ্য, এই তালিকায় একটিমাত্র বই ছাড়া সবগুলিরই বয়স ২০০-২৫০ বছর। অর্থাৎ, সেগুলি লেখা হয়েছিল সপ্তদশ বা অষ্টদশ শতকে। ব্যতিক্রম কেবলমাত্র পেত্রাস পুয়ার্দেসের এই গ্রন্থটি। সেটাও কি কম রহস্যময় নয়? নবজাগরণের যুগ থেকেই যে মানুষের চামড়ায় বই বাঁধাই-এর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ইউরোপে, বিজ্ঞানীদের ভাষায় যাকে বলা হয় ‘অ্যানথ্রোপোডার্মিক বিবলিওপেগি’, এই গ্রন্থই তার অন্যতম প্রমাণ। প্রশ্ন থেকে যায়, মানুষের চামড়ায় বাঁধানো সমসাময়িক অন্যান্য গ্রন্থগুলি তবে হারিয়ে গেল কীভাবে? আর এই গ্রন্থই বা ইউরোপ থেকে কাজাখস্থানে এসে জুটল কীভাবে?
প্রথম প্রশ্নটির উত্তর আজও অজানা গবেষকদের কাছে। অন্যদিকে ২০১৪ সালে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রত্নসংগ্রাহকের হাত ধরেই ল্যাটিন পাণ্ডুলিপি এসে পৌঁছায় আস্তানার ন্যাশনাল অ্যাকাডেমিক লাইব্রেরিতে। তারপরই শুরু হয়েছিল গবেষণা। একটু একটু প্রকাশ্যে আসে এই গ্রন্থের ইতিহাস। জট খুলতে থাকে রহস্যের। গবেষণার জন্য একাধিক ইতালীয় এবং ফরাসি গবেষণা সংস্থাতেও পাঠানো হয়েছিল পাণ্ডুলিপিটি। তবে সম্পূর্ণভাবে পাঠোদ্ধার করতে ব্যর্থ হন তাঁরা। এতদিন পর্যন্ত রহস্যময় এই গ্রন্থ সম্পর্কে বিস্তর লেখালিখি হলেও, লোকচক্ষুর আড়ালেই ছিল পাণ্ডুলিপিটি। এবার কাজাখস্তানের জাতীয় গ্রন্থাগারের উদ্যোগে তা প্রথমবার সামনে এল সাধারণ মানুষের…
Powered by Froala Editor