আঠেরো-উনিশ শতকে কলকেতায় দুর্গাপুজো মানে তো বনেদি বাড়ির পুজো ছিলই, তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিয়েছিল এক বিধর্মী দুর্গাপুজো। বীরভূমের জনপ্রিয় কুঠিয়াল ছিলেন জন চিপস। লোকের মুখে মুখে তাঁর নাম হয়ে গেছিল চিকবাহাদুর। মাত্র ষোলো বছর বয়সে কলকাতায় রাইটার হিসেবে এসে ধীরে ধীরে বীরভূমের সবচেয়ে বড় কমার্শিয়াল এজেন্ট। তুলা, রেশম, লাক্ষার জমাটি কারবার। থাকতেন শান্তিনিকেতনের কাছেই সুরুলে। সবই হচ্ছে, কিন্তু ব্যবসায় ভালো লাভ হচ্ছে না।
সাহেবের মন খারাপ। শেষে দেওয়ান শ্যামকিশোর সিংহ বুদ্ধি দিলেন ‘সাহেব, তুমি বড়ো করে দুর্গাপুজো করো দেখি। আমাদের মা কাউকে হেলা করেন না। তিনি নিশ্চয়ই তোমার দুর্গতি দূর করবেন।’
চিপস রাজি হলেন। সুরুলের কুঠিবাড়িতে ধুমধাম করে পুজো হল। সাহেব সকাল থেকে না খেয়ে অঞ্জলি দিলেন। চারিদিক থেকে মানুষ ছুটে এল এই কাণ্ড দেখতে।
তবে সবচেয়ে অবাক সাহেব নিজে। পরের বছর মুনাফা হল দ্বিগুণ। তিনি শ্যামকিশোরকে ডেকে বললেন, মা আমায় কৃপা করেছেন। এবার থেকে প্রতি বছর পুজো চাই-ই চাই। ১৮২৮ অবধি বেঁচে ছিলেন সাহেব। একবারও পুজো বাদ যায়নি। ভক্তিভরে মায়ের অর্চনা করতেন চিকবাহাদুর।
আরও পড়ুন
পা ভেঙেছে দুর্গার বাহনের, সিংহ পরিবারের কর্তাকে ঘিরে ধরল সবাই
হান্টার তাঁর ‘অ্যানালস অফ রুরাল বেঙ্গল’-এ লিখেছেন, এই পুজোতে চিপসের খরচ হত মোট পঞ্চাশ টাকা মতো। প্রতিমা, পুরোহিত ইত্যাদিতে সতেরো টাকা, আর বাকি যেত গাঁয়ের মানুষকে নতুন কাপড় দিতে। অষ্টমীর দিন গাঁয়ের সব মানুষের নেমতন্ন হত সাহেবের কুঠিতে। দুপুরে পেটভরে অন্নভোগ খেয়ে সবাই সাহেবকে দুহাত তুলে আশীর্বাদ করতে করতে বাড়ি যেতেন।
আরও পড়ুন
‘কচু ঘেঁচু’ জোটে দুর্গার কপালে! কবিতা ফাঁদলেন বঙ্কিম
তবে পুজোতে সাহেবদের মাতামাতি নেহাত কম ছিল না। অমৃতলাল বসু লিখছেন "স'বাজারের রাজার বাড়িতে লেগে যেত সাহেব মেম দর্শকদের ভীড়। সাদা মুখের শোভায় রাজবাড়ির উঠানে পদ্মফুলের মালা ফুটে উঠত আর আমরা কালো কালো অলিরা আশেপাশে ঘেঁষে গুঞ্জন করতুম। সাহেবদের জন্য শেরি শ্যাম্পেন ব্র্যান্ডি বিস্কুট থাকত বটে, ভাগ্যবান দু-দশজন বাঙালী প্রসাদও পেতেন। কিন্তু খাওয়া দাওয়ার বেলা বাঙালিদের ভাগ্যে ফক্কা।"। অবশ্য একই কথা ঈশ্বর গুপ্তও লিখেছেন—
আরও পড়ুন
ঢাকেশ্বরীর আদলে কলকাতায় অষ্টধাতুর দুর্গামূর্তি, এখনও চলছে সেই পুজো
‘খুলিয়া খানার পুঁতি সাম্পিনের ঘৃতাহুতি
হিপ হিপ হোরে স্বাহারব।
পুরোহিত উইলসন পুরোহিত সেই জন
ঠুন্ঠুন বাজে পাত্র সব।।’
সাহেবদের খুশি করতে বাড়াবাড়িও হত। ‘কালীশঙ্কর ঘোষের বাটীর গুরু পুরোহিত কর্তা প্রভৃতি পুরুষ, অন্দরে গৃহিণী এবং সমস্ত পুরোনারী মায় দাসদাসীকে পর্যন্ত সুরাপান করিতে হইত।’
Powered by Froala Editor