আজও সুফিবাদের ঐতিহ্যকে লালন করে চলেছে যে কাশ্মীরি গ্রাম

কাশ্মীরি ভাষায় যাকে বলে রায়েশ ওয়ায়ের (Raesh waer), অর্থাৎ সাধুসন্তদের আবাস, দক্ষিণ কাশ্মীরের সেই ছোট্ট গ্রামটি তমালহাল। ৪০০ বছর আগে এই গ্রামে এসে হযরত বাবা নসিবুদ্দিন গাজি একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। আজও গ্রামটির মানুষ সুফিবাদের আত্মাকে লালন করে চলেছেন। তমালহাল-বাসীদের আত্মশুদ্ধির পথ সুফি। তাঁদের মূল্যবোধ, আচার-প্রথা চর্চা সবই সুফিবাদকে কেন্দ্র করে।

দক্ষিণ কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলা সদর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে তমালহাল। গ্রামে প্রায় তিন হাজার মানুষের আবাসস্থল। আজও তমালহাল-বাসীরা মহান সুফি সাধকদের অনুশীলন এবং শিক্ষা অনুসরণ করে এই সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। গ্রামের ইতিহাস বলছে— সুফি ও খোদাপ্রেমী বুজুর্গ ছাড়াও দরবেশ, মালঙ্গ, কালান্দর, মজজুবদেরও জন্ম এই তমালহালে।

পুলওয়ামা জেলা সুফি কবি ও গায়ক ওয়াহাব খার, সুচ করাল, মোমিন শাহ সাহেব, গুলাম আহমেদ মাহজুর, হাবা খাতুন, কাদির সাহেব আলুপোরা প্রমুখের জন্মস্থান। গোলাম নবী মীর, ইউসুফ মনসুর শাহ এবং আহাঙ্গার মাস্তানার মতো বিশিষ্ট মজ্জুব এবং মালঙ্গের জন্ম তমালহালে। কাশ্মীরের সুপরিচিত সুফি কবি, লেখক এবং আধ্যাত্মিক সাধক হযরত পীর ফকির গোলাম নবী শাহ জহুর কাবারভিও এই গ্রামেরই বাসিন্দা। ১৯৮২ সালের মার্চে ইন্তেকাল করেন তিনি। দূর-দূরান্তের দরবেশ ও কালান্দরদের এই গ্রামে সর্বদাই দেখা মেলে তমালহাল গ্রামে। কাবারুয়া সিলসিলার সুপরিচিত বুজুর্গ হযরত সৈয়দ মহম্মদ জাফর মাটির ঢিবির মধ্যে ১২ বছর তপস্যা করেছেন এখানেই। বর্তমানে তাঁর দরগাহ শ্রীনগর শহরের রাওয়ালপুরা এলাকায়।

কাশ্মীরি সমাজের আধ্যাত্মিক দিকগুলির বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এখানে নেওয়া হয়। হযরত সৈয়দ মহম্মদ জাফর কাবরভীর বিশ্রামস্থলে এই সভাগুলি অনুষ্ঠিত হয়। প্রতি বছর রজব (ইসলামি মাস) মাসের ১৪ তারিখে তমালহাল-বাসীরা ঘটা করে হযরত সৈয়দ মহম্মদ জাফর কাবরভীর উরস উদযাপন করেন। গ্রামবাসীরা কৃষিকাজ ও উদ্যানপালনের পাশাপাশি ব্যবসায় নিয়োজিত থাকলেও সুফিবাদের দীক্ষায় তাঁদের জীবনযাত্রা প্রতিফলিত। দরবেশ, সুফি ও মালঙ্গ মানুষের সেবায় নিয়োজিত তমালহাল-বাসীরা। গ্রামের মানুষ তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাঁদের খাওয়া-দাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা তাঁরাই করেন।

আরও পড়ুন
কাশ্মীরে বিপন্নপ্রায় ফার্সি, সংরক্ষণের হাতিয়ার কবির পাণ্ডুলিপি

শীতকালে তমালহালের অনেকেই রাজস্থানের আজমীরে হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীর দরগায় যান। থাকে তমালহাল থেকে আজমীরে শরীফ পর্যন্ত সরাসরি বাসের ব্যবস্থা। দরগায় উরস এবং অন্যান্য ইসলামি উৎসবে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রেও গ্রামবাসীরা অন্যদের থেকে এগিয়েই।

আরও পড়ুন
বিলুপ্তির মুখে পেশা, দুশ্চিন্তায় কাশ্মীরের ইয়াক-হার্ডাররা

সুফিবাদকে আশ্রয় করে বেড়ে উঠেছে গ্রামবাসীদের জীবনচেতনা। কঠিন লড়াইয়ে জড়িয়ে থাকে ঈশ্বরে বিশ্বাস। ঐতিহ্য আর ইতিহাসের এক ব্যতিক্রমী মেলবন্ধনের সাক্ষী হয়ে আজও পথ হেঁটে চলেছে তমালহাল গ্রাম।

Powered by Froala Editor