লোকবলের অভাব, ধ্বংসের মুখে কাশ্মীরের ঐতিহ্যশালী পাথর খোদাই শিল্প

রাস্তায় বসে এক বৃদ্ধ পাথরের ওপর ছেনি-হাতুড়ি পিটিয়ে চলেছে একমনে। একটু একটু করে সেই পাথরের রূপও বদলে যাচ্ছে। তৈরি হচ্ছে চমৎকার সব জিনিস। একটা সময় কাশ্মীরে গেলে অনেক জায়গাতেই এমন দৃশ্য দেখা যেত। পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রও ছিল এখানকার খোদাই শিল্প। আর আজ সেই শিল্পই একটু একটু করে ধ্বংসের দিকে এগোচ্ছে। কপালে হাত ভূস্বর্গের বহু পরিবারের।

স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘সংতারস’। কাশ্মীরের বিস্তীর্ণ পার্বত্য উপত্যকা এবং ঝিলম, সিন্ধু, কিষাণগঙ্গার মতো নদী অববাহিকায় পড়ে থাকে শয়ে শয়ে পাথর। সেই পাথরগুলো নিয়ে এসে ছেনি-হাতুড়ি ও অন্যান্য যন্ত্র নিয়ে বসে পড়েন কাশ্মীরিরা। একটু একটু করে জন্ম নেয় শিল্প। কখনও ঝর্ণা, কখনও সমাধিফলক, মূর্তি— কঠিন পাথরগুলোর রূপই বদলে যায়। কয়েকশো বছর ধরে এই ‘সংতারস’ অর্থাৎ পাথর খোদাই শিল্প বেড়ে উঠেছে কাশ্মীরের উপত্যকায়। মুঘল আমলেও একের পর এক দর্শনীয় স্থানে নিজেদের ছাপ রেখেছেন এখানকার শিল্পীরা। কেবল পাম্পোর উপত্যকা নয়, ভূস্বর্গ জুড়ে হাজার হাজার মানুষের আয়ের উৎস ছিল এই শিল্প। মানুষরা আসতেন, কিনেও নিয়ে যেতেন। আর মন্ত্রের মতো কানে লেগে থাকত সেই পাথর খোদাইয়ের আওয়াজ। সেটাই অক্সিজেন দিত কাশ্মীরের শিল্পীদের… 

আর আজ? পাথরের আওয়াজ শোনা গেলেও, তেমন জোরালো আর নেই। বরং খানিক ম্রিয়মান। একটা সময় যে শিল্প বহু মানুষের পেট ভরাতো, আজ তার আর কদর নেই। এমনকি, খোদাই শিল্পীও কমে গেছে অনেক। কাশ্মীরের বৃদ্ধ সংতারস শিল্পীদের মুখে তাই হতাশার ছাপ। বহু প্রজন্ম ধরে যে পাথর খোদাইয়ের সূক্ষ্ম কাজ বয়ে নিয়ে আসছেন তাঁরা, সেটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লোক আজ খুবই কম। কেন? 

প্রথমত, একটা সাধারণ, কঠিন পাথরকে শৈল্পিক রূপ দিতে প্রয়োজন দীর্ঘ পরিশ্রম ও অধ্যাবসায়ের। এক একটি জিনিস তৈরি করতে প্রচুর সময় দিতে হয়। সেইসঙ্গে লাগে দক্ষতা আর ধৈর্য। ওই পরিবারগুলির বর্তমান প্রজন্ম সেই ধৈর্য দিতে নারাজ। সেইসঙ্গে মনে দ্বিধা, ‘লোকে কী বলবে?’ বেশিরভাগ মানুষই এই পাথর খোদাই শিল্পকে মনে করে নিচু স্তরের কাজ। কিন্তু এর দীর্ঘ ঐতিহ্য, ইতিহাস, নিষ্ঠা সম্পর্কে কি তাঁরা অবহিত? এই প্রশ্নই পাল্টা ছুঁড়ে দিচ্ছেন সংতারস শিল্পীরা। সবাই যে পাথরকে জীবন্ত করতে পারে না। কিন্তু তাও পরবর্তী প্রজন্ম মুখ ফিরিয়ে আছে। হাল ধরে গিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো সেরকম মানুষ নেই। লোক কমে আসার ফলে যা অর্ডার আসে, সেটা তৈরি করতে অনেক সময় লেগে যায়। ফলে সেইদিকেও একটা সময় ভাটা পড়ে। প্রতিটা পাথর খোদাই করার সময় হয়তো এই সমস্ত চিন্তাই মাথায় আসে কাশ্মীরের সংতারস শিল্পীদের। কপালে বলিরেখা বাড়ে, চুলেও পাক ধরে। তবুও ছেনি-হাতুড়ি চালিয়ে যান তাঁরা। কে জানে, কবে শেষের সেই দিনটি ঘনিয়ে আসে…   

Powered by Froala Editor