চারিদিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে সবুজ পাহাড়ের সারি। আর তার মাঝের উপত্যকা ঝলমল করছে হলুদ রঙের ছটায়। দিগন্তবিস্তৃত সরষের খেত মাথা দোলাচ্ছে হাওয়ায়। কাশ্মীরের (Kashmir) উঝ (Ujh River) নদীর তীরে কাঠুয়া জেলার দুঙ্গারা গ্রামের চেহারা এমনটাই। আক্ষরিক অর্থেই যেন স্বর্গরাজ্য। সরষে, গম, জাফরানের চাষ আর পশুপালনকে ঘিরে গড়ে ওঠা ছোট্ট এই জনপদের বয়স কয়েক শতক তো হবেই। কিন্তু বিচিত্র এই গ্রামের ভবিষ্যৎ ঘিরে ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে অনিশ্চয়তার কুয়াশা। কেন না, এখানেই গড়ে উঠতে চলেছে আস্ত জল বিদ্যুৎ প্রকল্প (Hydro Power Project)।
বিগত দুই দশকে হিমালয়ের বুকে একাধিক বাঁধ (Dam) নির্মাণের প্রকল্প নিয়েছে ভারত। তার মধ্যেই অন্যতম ছিল উঝ প্রকল্প। কেন্দ্রের ঘোষণা অনুযায়ী উঝ নদীর ওপরে স্থাপিত জলবিদ্যুৎকেন্দ্র ১৮৬ মেগাওয়াট শক্তি সরবরাহ করবে আগামী দিনে। ফলত শক্তির চাহিদা অনেকটাই কমবে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। কিন্তু তার মাশুল গুনতে হবে হাজার হাজার স্থানীয় বাসিন্দাকে। সেইসঙ্গে প্রকৃতিকেও।
উঝ প্রকল্পের নীল নকশা অনুযায়ী, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য কাটা পড়বে প্রায় ৩ লক্ষ গাছ। ইতিমধ্যেই যা সবুজ সংকেত পেয়ে গেছে প্রশাসনের থেকে। অন্যদিকে এই প্রকল্পের জন্য অধিকৃত হবে গোটা দুঙ্গারা গ্রামটিই। তাছাড়াও অল্পবিস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হবে পার্শ্ববর্তী আরও ৫২টি গ্রাম। সবমিলিয়ে গৃহহীন হবে প্রায় ৩৭০০ পরিবার। সরকার ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিলেও, তাতে সন্তুষ্ট নন গ্রামবাসীরা। অসন্তোষের কারণও বেশ স্পষ্ট। সরকারি উদ্যোগে নতুন বাসস্থান পেলেও, পুনর্বাসনের পর কৃষিকাজের জমিটাই যে পাবেন না তাঁরা। ফলত, বন্ধ হয়ে যাবে উপার্জনের পথটাই। সেইসঙ্গে, জমির অবস্থানের ভিত্তিতে আদৌ উপযুক্ত আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে কিনা, তা নিয়েও থেকে যাচ্ছে সন্দেহ।
তবে শুধু বাস্তুচ্যুতের সমস্যাই নয়, বরং আরও বড়ো আশঙ্কা মাথা চাড়া দিচ্ছে এই প্রকল্পকে ঘিরে। ফিরে আসছে উত্তরাখণ্ডের বিধ্বংসী ধ্বসের স্মৃতিই। হিমালয়ের বুকে পরিকল্পিত উঝ নদীর উপত্যকাও বাঁধ ও জলাধার নির্মাণের জন্য উপযুক্ত নয় বলেই অভিমত বিশেষজ্ঞদের একাংশের। ফলত, থেকেই যাচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা। পাশাপাশি, উঝের গতিপথে কোনো হিমবাহ না থাকায়, ব্যাঘাত ঘটতে পারে জলপ্রবাহেও। প্রশ্ন থেকে যায় তার পরেও কেন বিপদসংকুল এই পরিবেশ জলবিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরিতে আগ্রহী ভারত সরকার? এক কথায় উত্তর, অবস্থানগত গুরুত্ব। উঝ নদীই সিন্দুর উপনদী রবির অন্যতম জলের উৎস।
২০০৮ সালে কেন্দ্র সরকার এই প্রকল্পের কথা উল্লেখ করলেও এতদিন থমকে ছিল সেই কাজ। সিন্ধুর জলচুক্তির নিরিখে, প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানকে রাজনৈতিকভাবে চাপে রাখাই মূল উদ্দেশ্য ভারতের। তবে তার জন্য যে বড়োসড় মাশুল গুনতে হতে পারে ভবিষ্যতে, সে কথা ভেবে দেখা হচ্ছে না একবারও।
তবে উঝ মাল্টিপার্পাস প্রকল্পের জন্য প্রশাসন সবুজ সংকেত দিলেও, বাসস্থান এবং প্রকৃতি রক্ষার তাগিদে প্রতিবাদ চালিয়ে যাচ্ছেন দুঙ্গারা-সহ একাধিক গ্রামের কাশ্মীরিরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই প্রতিবাদ আদৌ ফলপ্রসূ হবে কিনা, জানা নেই কারোরই। একমাত্র সময়ই দিতে পারে সেই উত্তর…
Powered by Froala Editor