"হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।"
মাইকেল মধুসূদন দত্তের এই কবিতা আসলে তাঁর মাতৃভাষার কাছে ফিরে যাওয়ার প্রবল আকুতি। তবে শুধুই কি মধুকবি? না, তাঁর পূর্বসূরিও ছিলেন একজন। অধিকাংশ সময় ইংরেজিতে সাহিত্যচর্চা করলেও, তাঁরও ছিল দেশমায়ের কাছে ফিরে আসার আকুতি, প্রার্থনা। কিন্তু সাহিত্যজগতে প্রায় অনুচ্চারিতই থেকে গেছেন তিনি। তিনি, কাশীপ্রসাদ ঘোষ।
উনবিংশ শতক। বাংলার নবজাগরণের সময়। আর সেই সময়ই, ১৮০৯ সালে খিদিরপুরে মাতামহের বাড়িতে জন্ম নেন কাশীপ্রসাদ। তাঁদের বসতি ছিল উত্তর কলকাতার হেদুয়ায়। দাদু তুলসীরাম ঘোষ ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির খাজাঞ্চি। ফলে, ছোট থেকেই বিত্তের মধ্যে মানুষ হওয়া কাশীপ্রসাদের। কিন্তু ছোট্ট কাশীপ্রসাদ ছিলেন বড়ই দুরন্ত। পড়াশোনায় একদমই মন নেই। ১৮২১ সালে হিন্দু কলেজে (বর্তমান প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) পড়া শুরু হয় তাঁর। আর তখন থেকেই ভোল বদলে যায় তাঁর। পড়াশোনায় মন লাগত না যাঁর, তিনিই একসময় হিন্দু কলেজের সেরা ছাত্র হয়ে উঠলেন। এখান থেকেই বেড়ে উঠল তাঁর ইংরেজি দক্ষতা, সঙ্গে সাহিত্যপ্রীতিও। সেটা ঠিক কীরকম, একটি ঘটনাতেই বোঝা যাবে। একদিন কলেজ পরিদরশন করতে এসেছেন অধ্যাপক এইচ এইচ উইলসন। এসেই ছাত্রদের ইংরেজিতে একটি কবিতা লিখতে বলেন। কিন্তু কেউই সেটা পারে না। না, একটি ছাত্র পারে। ইংরেজিতে আস্ত একটা কবিতা লিখে পরিদর্শককে জমা দেন কিশোর কাশীপ্রসাদ।
শুধু এই একটা কবিতাই নয়, ছাত্র বয়স থেকেই নানা লেখা লিখতে থাকেন তিনি। তাতে যেমন ছিল কবিতা, তেমনই ছিল গ্রন্থ-সমালোচনা। তবে সবটাই হত ইংরেজিতে। ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়লেন কবিতার জালে। পত্রপত্রিকায় ছাপা হতে থাকল কাশীপ্রসাদ ঘোষের লেখা। প্রশংসা আসতে লাগল একে একে। যাঁদের মধ্যে ছিলেন ডেভিড হেয়ার, রাজা রাধাকান্ত দেবের মতো ব্যক্তিত্বরাও। এইভাবেই এক সময় লিখে ফেললেন ‘The Shair and other poems’ নামের কবিতার বই। বইটি পৌঁছে গেল বড়লাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের কাছে। তবে বইটি পড়ে কীরকম প্রতিক্রিয়া ছিল তাঁর, সেটা জানা যায়নি।
এই একটা বই লিখেই থেমে যাননি তিনি। কবিতা ছাড়াও আরও বেশ কিছু বিষয় বই লেখেন তিনি। যার মধ্যে ছিল বাংলার উৎসবগুলিকে নিয়ে কাব্য ‘The Hindu Festival’, ভারতের রাজাদের নিয়ে এবং সেই ইতিহাস নিয়ে লিখিত গবেষণামূলক বই ‘Memory of Indian Dynastics’, এমনকি তৎকালীন বাংলা কবিতা এবং কবিদের সমালোচনা করে লিখিত একটি বই ‘On Bengalee poetry’ আর ‘On Bengalee works and Writers’ ইত্যাদি। কিন্তু মাতৃভাষার টান যে বড় টান। ইংরেজিতে অধিকাংশ কাজ করলেও, নিজের বাংলাকে আপন করে নিতে ভোলেননি তিনি। কবিতা ছাড়াও তিনশোরও বেশি সংখ্যক গানও লিখেছিলেন তিনি। বাংলায় ফেরার ‘আকুতি’ মাইকেলের থেকে কম ছিল না তাঁর।
কবি কাশীপ্রসাদ ঘোষ ব্যক্তিগত জীবনে যথেষ্ট উচ্চপদে কাজ করেছেন। এমনকি সুপ্রিম কোর্টের গ্র্যান্ড জুরিও হয়েছিলেন তিনি। পুরসভার জাস্টিস অফ দ্য পিস ছিলেন তিনি। অবশ্য এইসব কিছুর পাশাপাশি আরও একটা পরিচয় রয়ে গেছে তাঁর। সেটা হল পত্রিকা সম্পাদকের। ১৮৪৫-এ নিজের উদ্যোগেই বের করতেন ‘The Hindu Intelligencer’ নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। এই পত্রিকা সেই সময় বহু নব্য তরুণের জন্ম দিয়েছে, পরবর্তীতে যাঁদের প্রতিভা অক্ষুণ্ণ থেকে গেছে। সেই তালিকায় যেমন ছিলেন নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষ, তেমনই আছেন হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ও।
কিন্তু কালের আঘাত যে বড় নিষ্ঠুর। এই হিন্দু ইন্টেলিজেন্সারের কথা এখন কেউই জানে না। কোনও কপিও সংরক্ষিত নেই। কাশীপ্রসাদ ঘোষের বইগুলিও কি আর আছে? ন্যাশনাল লাইব্রেরিতেই পাওয়া যায় তাঁর ‘The Shair and other poems’। হ্যাঁ, এখনও এই একটিই বই টিকে আছে এখানে। কাশীপ্রসাদ ঘোষকেই বা কোথায় মনে রেখেছে বঙ্গ সাহিত্য? যে বছর মারা গেলেন মাইকেল মধুসূদন, সেই বছরই, অর্থাৎ ১৮৭৩ সালে চলে যান কাশীপ্রসাদ। সেই চলে যাওয়াই তাঁর চিরতরে চলে যাওয়া। হেদুয়ার ৫৫বি অভেদানন্দ রোডের বাড়িটিরও অবস্থা ভালো নয়। মালিকের মতো, সেও হয়ত কোনও একদিন তলিয়ে যাবে ইতিহাসের ভেতর। সুমনের গানের মতো বারবার ভেসে উঠবে ‘কত কবি মরে গেল, চুপিচুপি, একা একা/ আমাদের জন্য’।
Powered by Froala Editor