ছোট্ট ঘরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য ভাস্কর্য। দেওয়ালে ঝুলছে চিত্রকলা। এসবের মাঝেই আয়োজন ‘পুজো’-র। হ্যাঁ, ঠাকুরের নাম যদি রবীন্দ্রনাথ (Rabindranath Tagore) হয়, তবে তাঁকে নৈবেদ্য অর্পণে এমন ঠাকুরঘরের প্রয়োজন আছে বৈকি। গত ১৭ জুলাই, রবিবার এমনই এক অন্যরকম আয়োজনের সাক্ষী থাকল কলকাতা। নেপথ্যে নিউটাউনের ‘কারু এক্সপেরিয়েন্স সেন্টার’ (The Karu Experience Centre)। গান ও পাঠের মধ্যে দিয়েই খোঁজ চলল রবীন্দ্রদর্শন এবং তাঁর সৃজনশীলতার নানান অধ্যায়ের।
রবীন্দ্রনাথের কবিতাই হোক কিংবা রবীন্দ্র-বিষয়ক প্রবন্ধের পাঠে বাচিকশিল্পী সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের (Sujoy Prasad Chattopadhyay) জুড়ি মেলা ভার। কারুর বিপণনকেন্দ্রে এদিনও শ্রোতাদের সামনে রবীন্দ্রদর্শন তুলে ধরার দায়িত্ব ছিল তাঁর কাঁধেই। আর এই আলোচনায় সঙ্গ দিয়েছিল সঙ্গীতশিল্পী দীপাঞ্জন পালের (Dipanjan Paul) কণ্ঠ।
না, রবীন্দ্রনাথের কোনো নির্দিষ্ট শিল্পচর্চা বা যাপনচিত্রকে ঘিরে কথা ও গানের এই দ্বৈরথ চলেনি। বরং সেই তরী ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে প্রতিটি ঘাট। শান্তিনিকেতন থেকে শ্রীনিকেতন, পল্লি পুনর্গঠন, স্বাদেশিকতা থেকে রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক যাপন— উঠে এসেছিল প্রতিটি প্রসঙ্গ। সুজয়প্রসাদের দরাজ কণ্ঠে কখনো উচ্চারিত হয় ‘জীবনদেবতা’ আবার কখনো তাঁর পাঠে উঠে আসে রবীন্দ্র-জীবনীকার উমা দাশগুপ্তের গ্রন্থের খণ্ডচিত্র। এই আলোচনা ও রবীন্দ্রপাঠের সঙ্গেই তাল মিলিয়ে পথ হেঁটেছে দীপাঞ্জন পালের গান। ‘আমাদের শান্তিনিকেতন’ বা ‘কেন চেয়ে আছ গো মা মুখপানে’ জাল বুনেছে এক অনন্য রবীন্দ্রজগতের।
আরও পড়ুন
নোটে রবীন্দ্রনাথ ও কালামের ছবি? ইঙ্গিত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের
“রবীন্দ্রনাথের সৃজনশীলতার যেকোনো মাধ্যম সম্পর্কে আলোচনা এবং চর্চা যে-কোনো সময়েই প্রাসঙ্গিক। তবে এই প্রজন্ম বই পড়ার থেকে দূরে সরছে ধীরে ধীরে। যাঁরা রবীন্দ্রনাথকে পাঠ করে চেনেন না, তাঁদের জন্য এই ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন অত্যন্ত জরুরি।”
আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকী উদযাপন মস্কোয়, প্রকাশিত কর্মজীবনের সম্পূর্ণ ক্যাটালগ
আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথের 'স্ত্রীর পত্র' ও সনাতন আবহ
বলছিলেন কলকাতার গভার্নমেন্ট কলেজ অফ আর্ট অ্যান্ড ক্রাফটের অধ্যাপিকা মীনা ঘোষ। দর্শকাসন আলো করে এদিন উপস্থিত ছিলেন তিনি। উপস্থিত ছিলেন রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ, আর্ট হিস্টোরিয়ান এবং শান্তিনিকেতনের কলাভবনের প্রাক্তন কিউরেটর সুশোভন অধিকারী। মনোগ্রাহী এই অনুষ্ঠানে সূত্রধরের ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনিই। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে দৃশ্যপট এবং চিত্রের সম্পর্ক, ছবি ও গানের এই সমান্তরাল গতিপথের কথাই উঠে আসে তাঁর প্রাক-কথনে। “কারু যেহেতু একটি আর্ট-হাউস, যেখানে গান এবং শিল্পকলা মিলছে এক ছাতার তলায়, সেখানে গানের ছবি ও ছবির গানের ওপর সুশোভনবাবুর এই বক্তব্য অন্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই সূত্র ধরেই পরবর্তীতে গান ও পাঠের মধ্যে দিয়েই অনুষ্ঠান এগোয়।”
কলকাতার মূল কেন্দ্রবিন্দু থেকে নিউটাউনের দূরত্ব অনেকটাই। তবুও শহরতলির এক প্রান্তে অবস্থিত এই আর্ট-হাউস এদিন ভর্তি হয়ে উঠেছিল কানায় কানায়। অনেকে কাচের দেওয়ালের বাইরে দাঁড়িয়েই উপভোগ করেছেন এই মনোগ্রাহী অনুষ্ঠান। স্বাদ নিয়েছেন রবীন্দ্রদর্শনের। কাজেই এই অনুষ্ঠান যে দর্শকদের মন ছুঁয়ে গেছে, তা নতুন করে বলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তবে এক রাশ মুগ্ধতা-ভরা অভিজ্ঞতা জানিয়েই সামান্য অভিযোগ করলেন অধ্যাপিকা মীনা ঘোষ। প্রশ্ন তুললেন, “সমগ্র রবীন্দ্রনাথকে কি এইটুকু অনুষ্ঠানে ধরা যায়? আর গোটা আলোচনা ও পাঠ যেহেতু ইংরাজিতে হল, রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলিরও অনূদিত ইংরাজি সংস্করণ উপস্থাপন করলে বোধ হয় তা আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠত।”
হ্যাঁ, কলকাতার বুকে ইংরাজি ভাষায় রবীন্দ্রচর্চা খানিক বাধতে পারে অনেকেরই। তবে আজকের দিনে যেখানে গোটা শহর ধীরে ধীরে ভুলে যাচ্ছে তার মাতৃভাষাকে, মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বই ও সংস্কৃতির থেকে, সেখানে দাঁড়িয়ে স্বীকার করতেই হয় মেট্রোপলিটনের মানুষদের রবীন্দ্রমুখী করতে এই অয়োজনের জুড়ি নেই। বলাই বাহুল্য, আগামীদিনে রবীন্দ্রচর্চার ক্ষেত্রে ‘কারু’-র এই অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে…
Powered by Froala Editor