সুদূর অ্যাডিলেডে ডন ব্র্যাডম্যান তখন ক্রিকেটের একের পর এক মাইলফলক চেনাচ্ছেন বিশ্বকে। সে-সময়ে খাস কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটের ৫২ নম্বর বাড়িতে তাঁকেই অনুসরণ করছেন এক বাঙালি। আজ সেই বাড়ি আর নেই। কিন্তু বাঙালির ক্রিকেট ইতিহাসে সে বাড়ির মালিকের নাম রয়ে গেছে স্বর্ণাক্ষরে। তিনি ‘ভারতের ব্র্যা।ডম্যান’ নৃপেন্দ্র মোহন বসু ওরফে কার্তিক বসু।
১৯০৬ সালে জন্ম তাঁর। স্যার ডনের ঠিক ২ বছর আগে। সমসাময়িক ক্রিকেটে, মূলত উপমহাদেশে, কার্তিক বসুই ড্রাইভের গোঁড়ামি ভেঙে অনেক বেশি করে কাট-পুল-হুক খেলার প্রথম নজির গড়েছিলেন। বাংলার হয়ে যখন অভিষেক হয় কার্তিকের, তখন ভারতের টেস্ট অধ্যায় শুরু হয়নি। ১৯৩০ সাল। কিছুদিনের মধ্যেই ভারত টেস্ট খেলিয়ে দেশের মর্যাদা পাবার পর সি কে নাইডু, ওয়াজিদ আলি, সোরাবজি কোলাহ-দের যে ব্যাটিং লাইনআপ, তাতে ঠাঁই মেলেনি কার্তিকের। এরপর এসেছিল মুশতাক আলি যুগ। ব্যাটিং লাইন-আপে সে-সময়ে কেন কার্তিক বসু-কে ভাবেনি ভারত, তার ব্যাখ্যা আজও অজানা।
১৯৩০ থেকে ১৯৫২ সাল অবধি ৪৪টি ফার্স্ট ক্লাসে তাঁর রান সংখ্যা ১৬৫৯। তবে শোনা যায়, ভারতীয় ক্রিকেটের নিয়ামক মূলত ব্রিটিশরা থাকাকালীন, অল ইন্ডিয়ান ক্রিকেট একাদশের গঠনকালে ১৯২৬ সাল নাগাদ কার্তিক বসু কিছু নীতির প্রতিবাদ করে সংস্থাকে চিঠি দেন। কার্তিক বসুর প্রসঙ্গে কিংবদন্তি ক্রিকেট রসিক ও ক্রীড়ালিখিয়ে শঙ্করী প্রসাদ বসু লিখছেন -
"ইন্দোরে মুশতাক আলির সঙ্গে একবার সাক্ষাতকারে আমরা বাঙালি ব্যাটসম্যান সম্বন্ধে প্রশ্ন করাতে মুস্তাক স্বয়ং কার্তিক বসুর নৈপুণ্যের কথা বলেছিলেন। প্রৌঢ় ক্রিকেট রসিক যাঁদের কাছে বাংলার ক্রিকেট বলতে ফ্রাঙ্ক টারান্ট, ক্যাম্বেল, হোসি, বিধু মুখুজ্জে, মণি দাস, এমনকি ফল্গু মালি বোঝায়, তাঁরাও কার্তিক বসুর প্রশংসা করেন যথেষ্ট..."
আরও পড়ুন
দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেগস্পিনার তিনি, বোর্ডের সঙ্গে সংঘাতে ছেড়েছিলেন ক্রিকেট
কার্তিক বসু টেস্ট ক্যাপ না পেলেও তাঁর ছাত্রেরা কিন্তু বাংলা তথা ভারতীয় ক্রিকেটকে সম্বৃদ্ধ করেছিলেন বহুদিন ধরে। মন্টু ব্যানার্জি, সম্বরণ ব্যানার্জি, পলি উমরিগড়, সেলিম দুরানি, চুণী গোস্বামী সকলেই আছেন সে-তালিকায়। স্বয়ং বিজয় মার্চেন্ট তাঁকে ক্রিকেট ক্লাব অফ ইন্ডিয়ার কোচ ও সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োজিত করেন। শুধু টেস্ট ক্যাপটাই হয়তো অধরামাধুরী হিসেবে থেকে গিয়েছিল কিংবদন্তি কার্ত্তিক বসুর জীবনে। তবে দুরন্ত ক্রিকেটার ও কোচ হওয়ার বাইরেও কার্তিকের আরেকটা পরিচয় না বললে হয়তো কিছুটা অন্যায়ই হবে। তাঁর পরিচয় বহন করত তার বাড়িটি। ৫২ নম্বর আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়িটির নামই ছিল ‘ঘুড়ি বাড়ি’। কার্তিক বসুর ঘুড়ি ওড়ানোর শখের কথা অজানা ছিল না কারও। শুধু কি ওড়ানো? বাড়ির নিচে বিখ্যাত বোস কাইট হাউস। ঘুড়ি বানাতেও দক্ষ ছিলেন কার্তিক। এই বাড়িতেই ছিল কত কিংবদন্তিদের আনাগোনা। পি কে ব্যানার্জি মাঝে মাঝেই এসে পড়তেন নিজের স্কুটার নিয়ে প্র্যাকটিস শেষে। শোনা যায়, 'শতরঞ্জ কি খিলাড়ি'-র সেই বিখ্যাত ঘুড়ি ওড়ানোর দৃশ্য চিত্রায়ণ নিয়ে সত্যজিৎ রীতিমতো আলোচনা করতেন কার্তিকের সঙ্গে।
আরও পড়ুন
ক্রিকেটের বিতর্কিত ‘মানকাডিং’ তাঁর নামেই; সাদা চামড়ার রাজনীতির শিকার বিনু মানকড়?
বাঙালি ক্রিকেট কর্মকর্তারা সেই তিরিশের দশকে কার্তিককে জাতীয় দলে সুযোগ করে দেবার জন্য আদৌ সেভাবে সদর্থক ভূমিকা নিয়েছিলেন কিনা, জানা যায় না। তবে জমিদার পরিবারের সন্তান হওয়ায় কোনোদিনই আর্থিক টানাপোড়েনে পড়তে হয়নি তাঁকে। নিজের খরচেই প্রায় ট্রেনিং দিতেন তরুণ ক্রিকেটারদের। বিজয় মার্চেন্টের মতো ক্রিকেটারের কাছেও তাই কার্তিক বসু একজন প্রকৃত শিক্ষক, যাঁর কথা বহু সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছিলেন ভারতের এই কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান।
আরও পড়ুন
এদেশের প্রথম দলিত ক্রিকেটার তিনি, ‘লগান’ সিনেমার কাছরা চরিত্রটির অনুপ্রেরণা
সেই ঘুড়ির দোকান এখন পালটে গেছে কচুরির দোকানে, পালটে গেছে এলাকার সবকিছুই। কার্তিক বসুর ক্রিকেটের স্মৃতি নিয়েই একটু একটু করে পালটে গেছে কল্লোলিনী কলকাতা৷ শুধু থেকে গেছে ফার্স্ট ক্লাসের ইনিংসগুলো। আজ হয়তো নাম বললে কেউ চট করে চিনেও উঠতে পারবেন না, কিন্তু পঙ্কজ-পূর্ববর্তী যুগে বাংলার ক্রিকেটে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান আজও কার্তিক বসু।
Powered by Froala Editor