মাত্র বছর তিনেক আগের কথা। নিজেদের বাসস্থান রক্ষা করতে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন কর্ণাটকের সলিহা উপজাতির মানুষরা। বিপক্ষে খোদ সরকারি বনবিভাগ। পশ্চিমঘাট পর্বতের দক্ষিণে বিলিগিরিরঙ্গ পাহাড়ের চারপাশে বনভূমিকে ঘিরেই কয়েকশ বছর ধরে বসবাস করছেন তাঁরা। অথচ বনবিভাগের মনে হয়েছিল, তাঁরা অরণ্য সংরক্ষণের কাজে বাধার সৃষ্টি করছেন। আদালতের যুদ্ধে সলিগা উপজাতির মানুষরাই জয়ী হয়েছিলেন। আর এর মধ্যেই আরও এক স্বীকৃতি পেলেন তাঁরা। আন্তর্জাতিক জার্নাল ফ্রন্টেয়ার ইন কনজারভেশন সায়েন্স-এ উঠে এসেছে তাঁদের জীবনযাত্রা কথা। গবেষকদের মতে, তাঁরা অরণ্য সংরক্ষণের কাজে প্রতিবন্ধকতা তো নন, বরং সলিগা উপজাতির জীবনযাত্রার ভিতর দিয়েই সংরক্ষণের প্রকৃত কর্মসূচি খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
অরণ্যের মধ্যে বাস করতে করতে অরণ্যকেই দেবতা বানিয়ে তুলেছেন সলিগা উপজাতির মানুষরা। এমনটাই বলছেন অশোকা ট্রাস্টের গবেষক ডঃ মগেগৌড়া। তিনি নিজেও এই উপজাতিরই একজন মানুষ। ছোট থেকেই দেখেছেন, জঙ্গলের প্রতিটা জন্তুকেই তাঁরা কোনো না কোনো দেবতার বাহন হিসাবে গণ্য করেন। আর সবার উপরে রয়েছেন অরণ্যের অধিষ্ঠাতা গরু। তাঁদের চিরাচরিত উপকথায় জানা যায়, মানুষ যখন অরণ্যে বসবাস শুরু করে তখন গরু গরু সমস্ত প্রাণীদের আত্মগোপন করতে বলেন। বলেছিলেন, তাঁর সন্তানরা আসছে। ওরা যেন ভয় না পায়। সেই থেকে বাঘেরা হয়ে আছে টিলা পাহাড়। ভাল্লুকগুলো পাথড়ের স্তূপ। হাতিরা মিলে রচনা করেছে বিরাট পর্বত। আর সাপেরা একে একে গাছের মতো উঠে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কোনো মানুষ যখন পাপ করেন, তখনই তারা আবার জীবিত হয়ে ওঠে। আর পাপিষ্ঠ মানুষরাই হিংস্র জন্তুর মুখে পড়ে।
তবে পাপ করেও জন্তু-জানোয়ারের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। আর তার জন্যই আছে সলিগা উপজাতির পূজা-আর্চার যাবতীয় পদ্ধতি। এইসব পদ্ধতির সঙ্গে আসলে জড়িয়ে আছে দীর্ঘদিনের অরণ্যজীবন। যেখানে মানুষ আর জন্তুরা একে অপরের প্রতিপক্ষ না হয়ে পাশাপাশি বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু ক্রমশ তাদের সেই জীবন থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আসছে আধুনিকতা। সলিগা উপজাতির মানুষরা তো বটেই, বিপন্ন প্রকৃতিও। এমনটাই জানাচ্ছে সাম্প্রতিক গবেষণা। সলিগা উপজাতির মানুষদের মতোই গবেষকরাও আশঙ্কিত সম্প্রতি গজিয়ে ওঠা ল্যান্টানা গাছের বাড়বাড়ন্ত দেখে। এখানকার মানুষ এই আগাছা আগে কখনও দেখেনি। তাদের ধারণা, ঈশ্বর আসলে রুষ্ট হয়েই এই বিষাক্ত গাছ প্রেরণ করেছেন। আর তার ফলে হারিয়ে যাচ্ছে অরণ্যের অতি পরিচিত সব লতাগাছ। যারা এক একটি তৃণভোজী প্রজাতির গুরুত্বপূর্ণ খাবার ছিল। এই আগাছাই শেষ করে ফেলতে পারে অরণ্যের বাস্তুতান্ত্রিক কাঠামোকে।
জীবনকে অকারণ আধুনিকতায় টেনে এনে পরিবেশ বাঁচানো সম্ভব নয়। বরং তাঁদের প্রচলিত পদ্ধতি থেকেই শিখতে হবে সংরক্ষণের নিয়ম। কিন্তু সেইসমস্ত রীতিনীতিও ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। আজকের প্রজন্মের মধ্যে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে আধুনিকতা। এখনই তাই অরণ্য জীবনের যাবতীয় শিক্ষাকে নথিভুক্ত করে ফেলতে না পারলে যথেষ্ট ক্ষতি ঘটে যাবে। সাম্প্রতিক এই গবেষণা সেই কাজটাই করার চেষ্টা করেছে। তবে এখনও অনেককিছুই জানা বাকি থেকে গিয়েছে। আগামীদিনে আরও বেশি করে অনুসন্ধান চলুক, এটাই চাইছেন গবেষকরা।
আরও পড়ুন
কোভিডে উপজাতি-মৃত্যুর সংখ্যা গোপন! অভিযোগে বিদ্ধ ব্রাজিল সরকার
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
ব্রাজিলের উপজাতির সঙ্গে বে-আইনি উত্তোলকদের সংঘর্ষ, উত্তপ্ত আমাজন