মোজেল নদীর ধার দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন এক ষাটোর্ধ্ব মানুষ। সঙ্গে তাঁর তরুণ বন্ধুবান্ধব এবং তরুণী মেয়ে। বিকেলের পড়ন্ত রোদ এসে চোখেমুখে লাগছে সকলের। সেই মায়াঘেরা বিকেলের বৈতালিকে আর পাখির কলকাকলির মধ্যেই জমে উঠেছে কথোপকথন। উঠে আসছে সমকালের কথা। যে সময়ের কথা বলছি, তখন সারা পৃথিবীজুড়ে গজিয়ে উঠছে বড় বড় কারখানা। সেই কারখানাকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে নতুন এক ধরণের অর্থনীতি। সেইসঙ্গে বদলাচ্ছে সমাজের চেহারা। বদলে যাওয়া সেই সময়ের কথা উঠে আসছে তাঁদের আড্ডায়।
মোজেল নদীর সেই পার একটি বছর কুড়ির যুবকের জীবনের বাঁক হয়ে থেকে গিয়েছিল। একদিকে প্রৌঢ় ওয়েস্টফেলেনের চোখ দিয়ে নতুন করে দেখছেন পৃথিবীটাকে। অন্যদিকে এক তরুণীর হাতছানি তাঁকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে সংসার তৈরির দিকে। এভাবেই শুরু হয়েছিল তাঁদের পথচলা। সেই পথে কখন যে তাঁরা ইতিহাস গড়ে ফেললেন, নিজেরাও হয়তো টের পাননি ঠিক করে।
কিছুদিনের মধ্যেই সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত হয়ে উঠবেন সেই যুবক। জীবনকালেই তাঁর নামে তৈরি হবে একটি রাজনৈতিক সংগঠন। তাঁর নাম কার্ল হেইনরিখ মার্ক্স। সমাজদর্শনের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক সূত্রের মেলবন্ধন ঘটিয়ে চমকে দিয়েছিলেন সবাইকে। আর সেই দর্শন যে ‘যাপনের দর্শন’। তাই ছাপ ফেলে গিয়েছিল তাঁর এবং তাঁর পরিবারের জীবনেও। অবশ্য এসবের মধ্যেও একটা মধুর প্রেমের সম্পর্ক থেকে গিয়েছিল সারা জীবন। যে সম্পর্কের পথচলা শুরু সেই মোজেল নদীর ধারে, ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে।
প্রৌঢ় লুডউইগ ওয়েস্টফেলেনের মেয়ে জেনি ওয়েস্টফেলেনের সেই হাতছানি তরুণ মার্ক্সকে নিয়ে গিয়েছিল এক অন্য পৃথিবীতে। একটা কবিতা লিখেছিলেন কার্ল মার্ক্স। তাতে লিখেছিলেন, আগামী শতাব্দী দেখতে চলেছে প্রেমই জেনি আর জেনিই প্রেমের নাম। তাই হতে পারত। কিন্তু মানুষ মার্ক্সকে আড়াল করে কখন যে দার্শনিক মার্ক্স ছায়া ফেলল, আর আমরাও রীতিমতো অগ্রাহ্য করে গেলাম এক অবিসংবাদী প্রেমের আখ্যানকে।
আরও পড়ুন
প্রেম নিবেদনের কয়েকদিন পরেই ফাঁসি, ১০ বছর ‘ফিরে আসা’র অপেক্ষায় কল্পনা
‘প্রকৃত বিপ্লবী প্রচেষ্টার পিছনে থাকে প্রেমের মহান অনুভূতি’। কথাটা বলেছিলেন চে গুয়েভারা। মার্ক্সের জীবনেও তেমনি মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল প্রেম এবং বিপ্লব। সেই অনুভূতির জায়গা থেকেই তিনি বুঝেছিলেন, মানুষে মানুষে সম্পর্কের প্রকৃত মূল্যায়ন সম্ভব প্রেমিক ও প্রেমিকার সম্পর্কের নিরিখে। তরুণ বয়সের সেই প্রেম ক্রমশ পরিণত হয়ে উঠলো। মার্ক্স তাঁর ডক্টরেট শেষ করলেন। জন্ম নিল মার্ক্স আর জেনির ছোট্ট সংসার।
খুব সহজ ছিল না সেই পথচলা। জেনির বাবার হাত ধরেই যে অন্য এক পৃথিবীতে পা রেখেছিলেন মার্ক্স। আজকাল আমরা যাকে ‘ইউটোপিয়া’ বলি। তাই যে সংসারকে তিনি ‘পেটি বুর্জোয়া’ মনে করতেন, সেই সংসারের মধ্যে বেঁধে রাখতে পারলেন না নিজেকে। খুঁজতে শুরু করলেন অর্থনীতির নিপীড়নের হাত থেকে শ্রমিকশ্রেণীর মুক্তির উপায়। আর তাঁর নিজের সংসারকে গ্রাস করল দারিদ্র্য, অপুষ্টি। চোখের সামনে মারা গেল তিন সন্তান। এক সন্তানকে বাধ্য হলেন দত্তক দিতে। কিন্তু এর মধ্যেও কোথাও চিড় ধরেনি তাঁদের সম্পর্কে।
আরও পড়ুন
নাৎজি সৈনিক ও ইহুদি বন্দিনীর প্রেম, যে অপূর্ণ সম্পর্কের সাক্ষী ছিল কনসেনট্রেশন ক্যাম্প
এর মধ্যেই মার্ক্স হাত দিলেন তাঁর ঐতিহাসিক ‘ক্যাপিটাল’ লেখার কাজে। ভেবেছিলেন তিন বছরে কাজ শেষ হবে। অথচ দেখতে দেখতে কেটে গেল ষোল বছর। এই ষোল বছর ধরে অন্য কোনদিকে মন দিতে পারেননি মার্ক্স। অথচ দিব্যি নিশ্চিন্তে সংসার টেনে গেছেন জেনি। তিন মেয়েকে বড়ো করেছেন। এমনকি বাবাকে সেভাবে কাছ থেকে না পেলেও মায়ের চোখ দিয়েই এক গভীর শ্রদ্ধা জন্ম নিয়েছিল তাঁদের মনে। তিনজনেই তাই জীবনসঙ্গী হিসাবে বেছে নিলেন তিন উদ্ভ্রান্ত যুবককে। রাজনীতির টানে যাঁরা ঘর ছেড়েছেন। মার্ক্সের কিন্তু তাতে সম্মতি ছিল না। এমনকি ছোট মেয়ে এলিনোরের প্রেমিক লিসাগ্যারেকে বলেছিলেন রাজনীতির অন্ধকার জগত ছেড়ে বেরিয়ে আসতে।
আসলে একটা সম্পর্কের জন্য প্রয়োজন গভীর বোঝাপড়া। সেটা বুঝেছিলেন মার্ক্স। খানিকটা তাঁর তত্ত্ব দিয়ে, আর বাকিটা জীবন দিয়ে। যে বোঝাপড়া তৈরি হয়েছিল তাঁর এবং জেনির মধ্যে। দুজনের জগত আলাদা হলেও কখনও মেয়ে বলে পিছিয়ে থাকতে হয়নি জেনিকে। কিন্তু তরুণ রাজনীতিকদের জীবনে সংগঠন, নেতৃত্ব এইসবের মোহ এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে তার আঁচ এসে পড়েছিল সংসারেও। পিতৃতন্ত্রের নিগড়টাই আরও শক্তিশালী হচ্ছিল। মার্ক্স নিজেও সেটা বুঝেছিলেন।
আরও পড়ুন
একতরফা প্রেমে ‘সঞ্চিতা’ উৎসর্গ করতে চাইলেন নজরুল, বিবাহ-সংবাদ পেয়ে লিখলেন গান
মার্ক্স আর জেনির সম্পর্কটা অনেকটাই বোঝা যায় তাঁদের চিঠিপত্র থেকে। বিশেষ করে ফ্রেড্রিক এঙ্গেলসকে লেখা চিঠিগুলি থেকে। আর বাকিটা বোঝা যায় এই সম্পর্কের পরিণতি দিয়ে। ১৮৮১ সাল। সারা জীবন দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে মারা গেলেন জেনি ওয়েস্টফেলেন, থুরি, জেনি মার্ক্স। তারপর সম্পূর্ণ দুটো বছরও পেরোল না। ১৮৮৩ সালে মার্ক্স নিজেও মারা গেলেন। আর তাঁর বুকপকেট থেকে পাওয়া গেল জেনির একটি ছবি।
মার্ক্স আর জেনির দাম্পত্য জীবন নিয়ে খুব কমই আলোচনা হয়েছে। অনেকটাই থেকে গেছে অজানা। তবে মার্ক্সের লেখায়, তাঁর দর্শনে প্রেম, সংসার, যৌনতার যে অভিঘাত তার সঠিক মূল্যায়ন করতে গেলে ফিরে তাকাতেই হবে তাঁর জীবনের দিকে। ২০০৮ সালের বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার পর থেকে নাকি আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন মার্ক্স। একলাফে বেড়ে গিয়েছে তাঁর ‘ক্যাপিটাল’এর বিক্রির পরিমাণ। কিন্তু তাঁর জীবন সেভাবে আলোচনার মধ্যে উঠে আসছে কি?
Powered by Froala Editor