২০০ বছর পেরিয়ে এসে এখনও পথ দেখাচ্ছেন কার্ল মার্ক্স। আক্ষরিক অর্থেই। মার্ক্সের জন্মস্থান ট্রিয়ের শহরে রাস্তার মোড়ে মোড়ে দেখা যায় এমনই দৃশ্য। শুধুই কার্ল মার্ক্স নন। জার্মানির ট্রাফিক সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণে তাঁর সঙ্গেই রয়েছেন এলভিস প্রিসলি (Elvis Presley)। পথচারীরা কখন রাস্তাপার করবেন, কখনই বা ফুটপাতের বাইরে পা রাখা চলবে না; সেই সব সংকেত জানিয়ে দেন তাঁরা। এমনই অভিনব ট্রাফিক সিগন্যাল চালু হয় বছর চারেক আগে। ২০১৮ সালে, কার্ল মার্ক্সের (Karl Marx) দ্বিশত জন্মবার্ষিকীতেই ট্রাফিক সিগন্যালে (Traffic Signal) আমাদের সবার চেনা স্টিক-ম্যানের পরিবর্তে বিকল্প চিহ্ন তৈরির পরিকল্পনা নেয় ট্রিয়ের শহর কর্তৃপক্ষ। এরপর জার্মানির অন্যান্য শহরেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই ব্যবস্থা।
অবশ্য ট্রাফিক সিগন্যালে শিল্পকর্ম খুব নতুন কিছু নয়। হ্যাঁ, অনেকের মনে হতেই পারে, তার প্রয়োজনই বা কী? স্টিক-ম্যান দিয়েই তো দিব্যি কাজ চলে যায়। নতুন নতুন নকশা তৈরি করা মানেই খরচ বেশি। সত্যি বলতে কী, শিল্পমাধ্যমেরই তাহলে কোনো প্রয়োজন থাকে না। তার ব্যবহারিক গুরুত্ব বিশেষ কিছু নেই। কিন্তু মনস্তত্ত্বের উপর তার প্রভাব রয়েছে। একই চিহ্ন দেখতে দেখতে অনেক সময় তা বিরক্তিকর হয়ে ওঠে। তখন ট্রাফিক সিগন্যালকে মানুষ গুরুত্ব দিতেও ভুলে যান। ঠিক এই সমস্যার সমাধানের জন্যই অভিনব উদ্যোগ নিয়েছিলেন ইস্ট বার্লিনের ট্রাফিক সার্জেন্ট কার্ল পেগলউ।
তখন ১৯৬১ সাল। বার্লিন শহরের মাঝে তখনও বিরাট এক দেয়াল দাঁড়িয়ে ছিল পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির সীমানা হয়ে। অবশ্য দুই জার্মানিতেই গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ছিল পথদুর্ঘটনা। এদিকে শহরের মানুষকে সচেতন করাও মুশকিল হয়ে পড়ছে। সবাই জানেন, ট্রাফিক সিগন্যালের সংকেত দেখে রাস্তা পারাপার করলেই দুর্ঘটনার প্রায় কোনো সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু সেদিকে কেউই বিশেষ গ্রাহ্য করেন না। কার্ল পেগলউ তখন স্টিক-ম্যানের পরিবর্তে তৈরি করলেন নতুন এক ডিজাইন। মাথায় হ্যাট-টুপি পরা এক ব্যক্তির নকশা বেছে নিলেন তিনি। আর এই নতুন নকশার নাম রাখলেন ‘অ্যাম্পেলমঁশিয়ে’।
পূর্ব জার্মানিতে বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছিল অ্যাম্পেলমঁশিয়ে। কিন্তু এরপর বার্লিনের প্রাচীর ভাঙে। দুই জার্মানি এক হয়ে যায়। আর পূর্ব জার্মানির অনেক ব্যবস্থার মতোই হারিয়ে যায় এই ট্রাফিক সিগন্যালের ডিজাইনও। তবে প্রায় ৬০ বছর পর আবার সেই পথে হাঁটল জার্মানি। উপলক্ষ কার্ল মার্ক্সের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে ট্রিয়ের শহর কর্তৃপক্ষ জানায়, মার্ক্সকে শ্রদ্ধা জানাতে ট্রাফিক সিগন্যালে জায়গা পাবে তাঁর ডুডল। যদি দেখা যায় লাল রঙের কার্ল মার্ক্স দুদিকে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, তাহলে বুঝতে হবে এখন রাস্তা পারাপার করা যাবে না। আর যদি দেখা যায় সবুজ রঙের কার্ল মার্ক্স কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো হাতে হেঁটে যাচ্ছেন, তাহলে বুঝতে হবে এইবার রাস্তা পেরনোর সময় হয়েছে।
আরও পড়ুন
ছিল ‘কার্ল মার্ক্স’, হয়ে গেল ‘জেনারেল শেরম্যান’, ২০০০ বছরের বুড়ো এক গাছের গপ্পো
বহু রাজনৈতিক বিতর্কের পরেও ট্রিয়ের শহরের এই উদ্যোগ বেশ সাড়া ফেলেছিল। সেই বছরই ফ্রিডবার্গ শহর সেখানকার ট্রাফিক সিগন্যালের জন্য বেছে নেন ‘রক অ্যান্ড রোল’ ধারার জনক এলভিস প্রেসলিকে। সঙ্গীতশিল্পী এলভিস প্রিসলি একটা বড়ো সময় কাটিয়ে গিয়েছেন ফ্রিডবার্গ এবং পার্শ্ববর্তী বাড-নুহেইম শহরে। এই দুই শহরের ট্রাফিক সিগন্যালেই দেখা যায় তাঁকে। লাল রঙের এলভিস দাঁড়িয়ে থাকেন তাঁর মাইক্রোফোনের সামনে। আর সবুজ রঙের এলভিসকে দেখা যায় তাঁর জনপ্রিয় হিপ-গাইরেটিং মুভে। অর্থাৎ, এবার রক অ্যান্ড রোলের সময়। মানে রাস্তা পারাপারের সময় আরকি।
আরও পড়ুন
কুড়ি বছর বয়সে শুরু প্রেম, নানা উত্থানপতনেও চিড় ধরেনি মার্ক্স-জেনির দাম্পত্যে
এছাড়াও জার্মানির বিভিন্ন শহরের ট্রাফিক সিগন্যালে দেখা গিয়েছে উনিশ শতকের ক্যাথলিক ধর্মযাজক সেবাস্তিয়ান নেইপকে। গাছেদের ডাক্তার বা জল-ডাক্তার নামে পরিচিত ছিলেন নেইপ। কারণ দিনের বেশিরভাগ সময় তিনি কাটিয়ে দিতেন রাস্তার ধারে গাছের নিচে জল দিতেই। পরিবেশ সংরক্ষণের বার্তাকে সামনে রেখেই ট্রাফিক সিগন্যালের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে তাঁকে। ভবিষ্যতে এমনই আরও নকশা তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে জার্মানিতে। আর ইতিমধ্যে জার্মানির বাইরেও তা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। হয়তো অন্যান্য দেশেও কিংবদন্তিদের স্মৃতি ধরে রাখতে একইভাবে বেছে নেওয়া হবে ট্রাফিক সিগন্যালকেই।
আরও পড়ুন
পদাবলি, মার্ক্স, রবীন্দ্রনাথ ও মধ্যরাতের ঠাট কাফি
Powered by Froala Editor