এখনও শুকায়নি ক্ষতচিহ্ন। জায়গায় জায়গায় মাটি থেকে মাথা উঁচিয়ে রয়েছে কেটে ফেলা গাছের গুঁড়ি। স্পষ্ট ফুটে রয়েছে বৃক্ষচ্ছেদনের ছাপ। কোথাও আবার কয়েক মানুষ গভীর গর্ত। তাতে জমে থাকা জল পরীক্ষা করলেই টের পাওয়া যাবে সীসা, পারদ, আর্সেনিকের মতো ভয়ঙ্কর দূষকদের উপস্থিতি। তবে আজ থেকে ছ’-সাত দশক আগেও এই অঞ্চলেই দাঁড়িয়ে ছিল ভেনেজুয়েলার অন্যতম বৈচিত্রময় অরণ্য। ঘনত্বের নিরিখে যা আমাজনের সমতুল্য।
এই ছবি ভেনেজুয়েলার বৃহত্তম সংরক্ষিত অরণ্য ইমাটাকা ফরেস্ট রিজার্ভের (Imataka Forest Reserve)। বিশ শতকের শুরু থেকেই প্রকৃতির ওপর আগ্রাসন বৃদ্ধি পেয়েছিল মানুষের। পঞ্চাশের দশকের পর থেকে দ্রুত হারে বৃদ্ধি পায় বৃক্ষচ্ছেদনের মাত্রা। লগিং এবং অবৈধ খননের জেরে প্রায় ফাঁকা হয়ে যায় অরণ্যের একটি বড়ো অংশ। পরিসংখ্যান বলছে অরণ্যের প্রায় ৪০ শতাংশ বৃক্ষ কাটা পড়েছে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের হাতে।
প্রকৃতির এই ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধেই যেন বর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছেন সেখানকার আদি ভূমিপুত্ররা। বা, বলা ভালো ভূমিকন্যারা। হ্যাঁ, এই অরণ্যেই কয়েক শতাব্দী ধরে বসবাস স্থানী কারিনা উপজাতির (Karina Tribal Women)। এবার এই উপজাতির মহিলারাই লড়াই করছেন জঙ্গলের প্রাণ ফিরিয়ে আনতে। শুধু প্রকৃতিই নয় অনিয়ন্ত্রিত বৃক্ষচ্ছেদন এবং খননের শিকার হয়েছেন মাটির গা ঘেঁষে থাকা এই মানুষগুলিও।
মূলত, পশু ও মৎস্যশিকারের ওপরেই নির্ভরশীল ছিল তাঁদের জীবনযাপন। কিন্তু অরণ্য ক্রমে ফাঁকা হয়ে যেতে দ্রুত অবলুপ্ত হতে থাকে সেখানকার বৈচিত্রময় বাস্তুতন্ত্র। এই ঘটনার বিরুদ্ধেই জনমত গড়ে তোলেন কারিন উপজাতির সদস্যা সিসিলিয়া রিভাস। শুরু করেন আন্দোলন। সেইসঙ্গে তাঁর নেতৃত্বে শুরু হয় অরণ্যে টহলদারি।
আরও পড়ুন
সামগ্রিকভাবে অরণ্যাঞ্চল বাড়লেও কমেছে অরণ্য, জানাচ্ছে রিপোর্টের বিশ্লেষণ
অবশ্য খুব কিছু সহজ ছিল না এই কাজ। আগ্নেয়াস্ত্র-সজ্জিত মাফিয়াদের হুমকির সম্মুখীন হতে হয়েছে বার বার। এসেছে প্রাণনাশের হুমকিও। তবে পিছপা হননি রিভাস ও তাঁর সহকর্মীরা। ২০১৬ সালে জাতিসঙ্ঘের কাছে দ্বারস্থ হন সিসিলিয়া। সমাধানসূত্র উঠে আসে তাঁর আবেদন থেকেই। বৈদেশিক চাপে পড়ে অরণ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করে ভেনেজুয়েলা প্রশাসন। সেইসঙ্গে অরণ্যের প্রায় ৭০০০ হেক্টর অঞ্চলের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ও অধিকার তুলে দেওয়া হয় কারিনা উপজাতির হাতে।
আরও পড়ুন
৫০০ একর অরণ্য প্রত্যার্পণ উপজাতিদের
২০১৯ সাল থেকে এই অরণ্যের অভিভাবক কারিনা উপজাতির মহিলারাই। আর তাঁদের নির্বাচিত ‘ক্যাপ্টেন’ এখন সিসিলিয়া। তাঁর নেতৃত্বেই নতুন করে প্রাণ ফিরছে ভেনেজুয়েলার এই অরণ্যে। যা স্থানীয় ভাষায় পরিচিত টুকুপু নামে। পাশাপাশি বনজ প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহারের এক নজিরও গড়েছে ল্যাটিন আমেরিকার এই জনগোষ্ঠী। নতুন করে বৃক্ষরোপণ এবং খননকেন্দ্রগুলি বুজিয়ে হাল ফিরিয়েছেন অরণ্যের। ফিরেছে বহু প্রজাতির প্রাণীও। সাম্প্রতিক গবেষণা জানাচ্ছে, বিগত কয়েক দশকের মধ্যে কার্বন শোষণের হার সর্বোচ্চ মানে পৌঁছেছে ইমাটাকা ফরেস্ট রিজার্ভে।
আরও পড়ুন
অরণ্য ফেরাতে ১৪ হাজার একর জমি ক্রয়, নজির গড়ল ডাচ সংস্থা
এর আগে পরিবেশকর্মী ও গবেষকরা একাধিকবার দাবি জানিয়েছিলেন অরণ্যের দায়িত্ব প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মানুষদের হাতে তুলে দেওয়া হলে, রক্ষা পাবে অরণ্য। সেই অনুমানকেই যেন প্রমাণ করে দেখালেন কারিনা উপজাতির মানুষেরা। তবে শুধু কারিনা নয়, ইমাটাকায় বসবাস করেন আরও বেশ কিছু প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মানুষ। তাঁদের হাতে অরণ্যের বাকি অংশের দায়িত্ব তুলে দিলে অনেকটাই ‘রোগমুক্ত’ হবে প্রকৃতি, তাতে সন্দেহ নেই কোনো…
Powered by Froala Editor