তৃতীয় পর্ব
রাত্যের বেলি লাচা গানা
ভাদু টুসু ঝুমুর
আইবুড়িরাই লাচে সবাই
বাঁধে পায়ে লুপুর
করম পরব ঘিরে বিভিন্ন মিথ বা উপকথার প্রচলন আছে এই মানভূম-জঙ্গলমহল অঞ্চলে। কিন্তু আধুনিক সমাজের তীব্র খিদে ক্রমশ গিলে নিচ্ছে এইসব গল্পগাছাকে। তার মধ্যেই দু’-একটি গল্প এখনও শোনা যায় এখানকার বাতাসে কান পাতলে। তার কিছু অংশ ভাগ করে নিতে ইচ্ছে হয় শহরে ফিরে, তথাকথিত সোশ্যাল মিডিয়া সম্বলিত ‘আধুনিক’ মানুষদের সঙ্গে।
প্রথম পর্ব
বৃক্ষকে ঘিরে মানবিক চেতনার এক চিরন্তন উৎসব করম পরব
এরকমই একটি গল্পে বলা হয়েছে সেই বৃক্ষকে জাগানোর কথাই। সেই কোন এক কালে জঙ্গলমহলের কোনও এক গ্রামে বসত ছিল সাত ভাইয়ের। চাষবাস করে দিন কাটত তাদের। সকাল থেকে ক্ষেতে কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে, দুপুরবেলায় তাদের জন্য বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসত সাত ভাইয়ের সাত বউ। এরকমই এক দুপুরে সাত বউ দূর গ্রাম থেকে খাবার নিয়ে এসেছে পায়ে হেঁটে। কিন্তু অন্যান্য দিনের মতো তাদের স্বামীদের আজকে যেন কোনও হুঁশই নেই খাবারের দিকে। আকাশের মেঘ দেখে যেন পাগলের মত পরিশ্রম করছে তারা মাঠে। দুপুর পেরিয়ে যায়, সাত ভাই আর খেতে আসে না। খাবার নিয়ে সাত বউ ফিরে যায় বাড়িতে। এর জবাব দেওয়ার জন্য সাত বউ ঠিক করে পরদিন দুপুরে আর খাবার নিয়ে যাবে না কেউ। খিদে-তেষ্টায় কাতর হয়ে সাত ভাই পরের দিন যখন ফিরে এল বাড়িতে, দেখল তাদের বউয়েরা আনন্দে মশগুল হয়ে নাচ-গান করে চলেছে বাড়ির করম গাছকে ঘিরে। রাগে উন্মাদ হয়ে সাত ভাই নিমেষে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিল সেই বৃক্ষকে। অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হলেন বৃক্ষ দেবতা। সাত ভাইয়ের মনে আর কোনও আনন্দ রইল না। ধান রইল না ক্ষেতে। পারিবারিক অবস্থার চূড়ান্ত অবনতির সম্মুখে তাদের পথ দেখালেন এক ব্রাহ্মণ। তিনি তাদের বললেন শক্তি জীবন যৌবন ও সমৃদ্ধির দেবতা করম ভগবানের পুজো করতে। সেই ব্রাহ্মণের কথা শুনেই আবার সুদিন ফিরল সাত ভাইয়ের পরিবারে।
জোর দেও শরীরে,
টুকু সুখ ধরি রে;
ধনি মন আসুক আসুক করে গো;
ধনি মন আসুক আসুক করে।।
এই আপাত নিরীহ, সহজ সাধারণ গল্পের মধ্যে দিয়ে মনে হয় বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রকৃতির সঙ্গে, বৃক্ষের সঙ্গে মানুষের চিরকালীন আত্মিক সম্পর্কের কথাটিই।
দ্বিতীয় পর্ব
কুমারী মেয়েদের ডালি পেয়ে তুষ্ট হন করম দেবতা
করম পরবের সঙ্গে যুক্ত আরেকটি কাহিনিতে পাওয়া যায় কিছু ইতিহাসের ছোঁয়া। মেবারের কাছে একটি প্রদেশের রাজা ছিলেন করম সিং ঠাকুর। তার পাশের রাজ্যের রাজা শুনেছিলেন বাংলাদেশের বিপুল ঐশ্বর্যের কথা। তিনি করম সিং ঠাকুরকে আবেদন করেন এই বাংলা জয়ের যুদ্ধে তাঁকে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু মালভূমি অঞ্চলের ঘন জঙ্গলে পথ হারায় রাজপুত সৈন্য-সামন্তরা। যুদ্ধের অভিশাপে তারা আর ফেরত যেতে পারে না নিজেদের দেশে। বাধ্য হয়ে তাদের শুরু করতে হয় চাষবাসের কাজ। তারপর ধীরে ধীরে তারা প্রত্যেকেই হয়ে যায় এই অরণ্যের সন্তান। করম পূজার কোনও কোনও গানে তাই চলেও আসে হয়তো দেশের পশ্চিম প্রান্তের কোনও প্রদেশের শব্দ!
সেই সব শব্দ থেকে সরে এসে, দূর শহরে বসে শুধু মনে করি, কাঁসাই বা কুমারীতে ভাসানো সেই সব জাওয়া ডালি থেকে কখনও কি একটুকরো মেঠো সুর ফিরে আসবে না আমাদের এই ছাপোষা মফস্বলে? আমাদের সর্বগ্রাসী আধুনিকতা কি ধুলোয় মিশিয়ে দেবে এই সব ঐতিহ্য?
ছবি ঋণ - ইউটিউব