দ্বিতীয় পর্ব
ভাদর মাসে করম পরব
মুদের ঘরে ঘরে
বাঁজা মাটি গাভিন হবেক
বীজের ফোড়্যে ফোড়্যে
করম পরবের প্রচলিত ক্রিয়াকর্মের দিকে একটু চোখ ফেরানো যাক। প্রতিবছর ভাদ্র মাসের শুক্লা একাদশী তিথিতে হয়ে থাকে এই করম পরব। সাধারণভাবে এর ক্রিয়াকর্ম শুরু হয় মূল তিথির তিনদিন, পাঁচদিন বা সাতদিন আগে থেকে। সেই সময় গ্রামের কুমারী মেয়েরা ভোর বেলায় সংগ্রহ করে শাল গাছের ডাল। এর নাম দেওয়া হয় দাঁতন কাঠি।
প্রথম পর্ব
বৃক্ষকে ঘিরে মানবিক চেতনার এক চিরন্তন উৎসব 'করম পরব'
করম পূজার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে আরও একটি আদিবাসী পরব, ‘জাওয়া’। একই সময়ে অনুষ্ঠিত হয় এই পরবটিও। এটি একেবারেই আরাধ্যা প্রজনন দেবীকে তুষ্ট করার পুজো। জাওয়া পরবের কয়েকদিন আগে থেকে একটি বেতের টুপা বা চুবড়িতে বালি ভরে, তার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয় ডাল-মুগ-বুটা প্রভৃতি শস্যের বীজ। রোদে-জলে কয়েকদিনের মধ্যেই চুবড়িটি ভরে ওঠে শস্যের অঙ্কুরে। যে কন্যার চুবড়ি লাবণ্য পায় যত বেশি, তার উর্বরতা তত বেশি মনে করা হয়। করম হল সক্ষমতা, যৌবন ও সমৃদ্ধির দেবতার পূজা। আবার জাওয়া উৎসবেও আরাধনা করা হয় প্রজননের বা উর্বরতার দেবীর। সেই কারণেই হয়তো এই দুই উৎসব একত্রিত হয়ে নাম হয়েছে ‘করম-জাওয়া’ পরব।
তৃতীয় পর্ব
সাত ভাই আর গাছ-দেবতার গল্প বলে করম পরব
সেই শালের দাঁতন কাঠি নিয়ে নদীতে বা পুকুরে স্নান করে মেয়েরা ডালাগুলিকে রাখে গ্রামের প্রান্তিক একটি স্থানে। শুরু হয়ে জাওয়া গান। সেই গান গাইতে গাইতে তিন বার ঘোরা হয় ডালাগুলিকে ঘিরে। কুমারী ও অবিবাহিত মেয়েরা এরপর ভিজে কাপড়ে ছোট ছোট শালপাতার থালায় রাখে বীজগুলিকে। তাতে এঁকে দেওয়া হয় কাজলের তিনটি দাগ। এই যে সম্পূর্ণ হওয়া ডালা, এর নাম ‘জাওয়া ডালি’। বিভিন্ন লোকসংস্কৃতি গবেষকেরাও মনে করেন, ডালায় অঙ্কুরিত এই দানা শস্যগুলি প্রজননের প্রতীক। উন্নত শস্য ও সুস্থ-সবল জনগণ দিয়ে সমাজ গড়ার বার্তা রয়েছে এই উৎসবে। এরপর প্রত্যেকটি জাওয়া আলাদা করে চিহ্নিত করার জন্য পুঁতে দেওয়া হয় কাশ গাছের কান্ড বা কাশকাঠি। একে বলা হয় ‘জাওয়া পাতা’। যে সমস্ত কুমারী মেয়েরা সম্পূর্ণ করে এই পদ্ধতিটি, তাদেরকে বলা হয় ‘জাওয়ার মা’। বেলা পড়ে আসে। ভবিষ্যতের সুস্থ আনন্দোচ্ছল হাসি মুখের সন্তানদের কথা মনে করতে করতে জাওয়াগুলিকে নিয়ে গ্রাম্য পুকুর পারের চড়াই-উৎরাই রাস্তা ধরে ‘জাওয়ার মা’য়েরা গ্রামে ফিরে আসে গান গাইতে গাইতে।
প্রচলিত বিশ্বাস, এই বিশেষ তিথিতে ভগবান বিষ্ণু অনন্ত শয্যায় পাশ ফিরে তাকিয়েছিলেন এই পৃথিবীর দিকে। যেই দিকে দৃষ্টি পড়েছিল ভগবানের, পৃথিবীর সেই অংশ হয়ে উঠেছিল সুজলা-সুফলা। এদিকে এক নিঃসন্তান রাজা সন্তান কামনায় পুজো করেছিলেন করম দেবতার। সেই রাজার দুই সন্তান হয়— কর্মু আর ধর্মু। পরে রাজপুত্র কর্মুর উদ্যোগে এক পুণ্য লগ্নে মাহাতো কুড়মি সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলন হয় করম পুজোর।
তাই এই করম পুজোর দিন দু’টি করম ডাল এনে পুঁতে রাখা হয় গ্রামের মাথা বা ‘মাঝি’দের নির্দিষ্ট করে দেওয়া স্থানে। সন্ধ্যার পরে এগুলোই পূজিত হন ‘করম ঠাকুর’ এবং ‘ধরম ঠাকুর’ হিসেবে। সারাদিনের উপবাসের পর সন্ধ্যা হলে কুমারী মেয়েরা থালায় ফুল, ফল সাজিয়ে পূজা করেন এই দেবতাদের। করম ডালকে জড়িয়ে ধরে দেওয়া হয় ‘ভেঁট’, যা বৃক্ষের প্রতি ভালবাসা ও উৎসর্গের প্রতীক বলেই মনে করা হয়। সারা রাত করম ডাল ও জাওয়া ডালিকে ঘিরে নাচ-গানের পর পরের দিন সকালে মেয়েরা জাওয়া থেকে অঙ্কুরিত বীজগুলি নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়ে ছড়িয়ে দেয় নিজের নিজের বাড়ির বিভিন্ন স্থানে। পাথুরে নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয় করম ডালটিকে।
(ক্রমশ)
ছবি ঋণ - ইউটিউব