ভারতবর্ষের ইতিহাসকে আমূল বদলে দিয়েছিলেন তিনি। তিনি কপিলাবস্তুর রাজা শাক্যসিংহ। রাজ্যপাট পরিত্যাগ করে একদিন নগরের পূর্বতোরণ দিয়ে চলে গেলেন। তারপর মানুষের দুঃখ দুর্দশার হদিশ খুঁজতে শুরু করলেন দীর্ঘ তপস্যা। তিনিই বুদ্ধদেব। কিন্তু কোথায় ছিল এই কপিলাবস্তু? কোথায় সেই লুম্বিনী, যেখানে জন্মেছিলেন বুদ্ধদেব? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে অনেকটা সময় লেগেছিল ঐতিহাসিকদের। বহু তরজা, বহু মতানৈক্য চলেছে। অবশেষে বিশ শতকের শেষের সঠিক উত্তর মিলেছে। উত্তর মিলেছে এক বাঙালির হাত ধরে।
গোরক্ষপুরের উত্তর-পশ্চিমে বুলিয়া তাল নামে একটি হ্রদের কাছে একটি প্রাচীন নগরের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পান আর্চিবল্ড কার্লাইল। সেটা ১৮৭০-এর দশক। কার্লাইলের মনে হয়, এই বুঝি কপিলাবস্তু। তাঁর মতকে সমর্থন করেছিলেন কানিংহোম। কিন্তু অনেকেই একথা মানতে চাইছিলেন না। তবে কানিংহোমের উপর যে কথা বলা চলে না। পরে ডা. আন্টন ফ্যুরার জোর দিয়ে বলেন, বুলিয়া তাল কপিলাবস্তু নয়। আবার শুরু হল অনুসন্ধানের কাজ। ১৮৯০-এর দশকে কপিলাবস্তুর অবস্থান খুঁজতে এগিয়ে আসেন অস্টিন ওয়াডেল নামে এক প্রত্নতাত্ত্বিক। ১৮৯৩ সালে রাপ্তি নদীর মোহনায় একটি নগরের ধ্বংসাবশেষকে কপিলাবস্তু বলে উল্লেখ করেন ওয়াডেল। কিন্তু তাঁর মত মানেন না কেউই। এর মধ্যে সত্যিকারের লুম্বিনী খুঁজে পেলেন ফ্যুরার। সেইসঙ্গে ওয়াডেলের মত ভ্রান্ত প্রমাণ করতে যুক্তি সাজালেন। অতএব আবার শুরু হল অনুসন্ধান। খুঁজে দেখতে হবে নেপালের তরাই অঞ্চলে। কিন্তু এর মধ্যেই ফ্যুরার অবসর নিলেন। অতএব কাজের দায়িত্ব নেওয়ার কথা ওয়াডেলের। কিন্তু ফ্যুরার এই কাজের দায়িত্ব দিলেন এক বাঙালিকে। তিনি বাবু পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ওরফে পি. সি. মুখার্জি।
ভারতের ইতিহাস বাবু পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে মনে রেখেছে কপিলাবস্তু আবিষ্কারের জন্যই। নাহলে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিও তাঁর ছিল না। প্রবল অর্থকষ্টের মধ্যে বেশিদিন পড়াশুনো টেনে নিয়ে যেতে পারেননি। একসময় কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেই চর্চাও চালিয়ে যেতে পারেননি। মহাকাব্য লিখতে লিখতেই শুরু করেন লখনৌ শহরের ইতিহাস লেখার কাজ। সেই বই লেখার জন্য ছবি আঁকাও শেখেন।
১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে সরকারি প্রত্নতাত্ত্বিকের কাজ শুরু করেন পূর্ণচন্দ্র। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে তাঁকে মেনে নিতে পারেননি অনেকেই। ফলে পদত্যাগ করে পিডব্লিউডির কাজে যোগ দেন। কিন্তু পুরাতত্ত্ব ততদিনে তাঁর মন ছুঁয়ে গিয়েছে। বিহারের ললিতপুর ও আশেপাশের নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন খুঁজতে থাকেন তিনি। আর এএসআই থেকে আবার ডাক আসে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে। পাটুলিপূত্র নগরের সন্ধানে তখন খননকার্য চলছে। সেই কাজের তদারকির ভার দেওয়া হয় পূর্ণচন্দ্রকে। আর তিনি সেই ধ্বংসাবশেষ খুঁজেও পেলেন। আর তারপর?
কপিলাবস্তুর সন্ধানে খননকার্য পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন পূর্ণচন্দ্র। সমস্ত কাজের তদারকি করলেন স্বয়ং ভিনসেন্ট স্মিথ। কাজ শুরু হল ১৮৯৯ সালের জানুয়ারি মাসে। ওদিকে ক্রমাগত বাধা সৃষ্টি করতে থাকেন ওয়াডেল। পূর্ণচন্দ্রের নামে সরকারের কাছে নালিশও করেন। সরকার অবশ্য তাঁকে কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু ওয়াডেলের কাজে বিরক্ত হয়ে ওঠেন পূর্ণচন্দ্র। তবে হাল ছাড়েন না। এর আগে পাটুলিপূত্র নগরের সন্ধানে খননকার্য করেছেন তিনি। সেখান থেকেই ওয়াডেলের সঙ্গে তাঁর শত্রুতা। সেবারেও ওয়াডেলের বদলে পূর্ণচন্দ্রকেই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। অতএব এমন ঝামেলা সামলানোর অভিজ্ঞতা তাঁর আছে।
এর মধ্যে পূর্ণচন্দ্র বাবু হঠাৎ ভাবেন, তিলৌরাকোট অঞ্চলটি বারবার উপেক্ষা করে গিয়েছেন ইংরেজ বিশেষজ্ঞরা। অথচ তাঁর মনে হতে থাকে, ওখানেই খুঁজে পাওয়া যাবে কপিলাবস্তু। তিনি খননকার্য শুরু করলেন। ওদিকে শ্রমিকদের নিয়ে ওয়াডেল চলে গেলেন গোতিহাওয়া। কিন্তু পূর্ণচন্দ্র একাই কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন। আর ওয়াডেল যখন ফিরলেন তখন তাঁর সামনে কপিলাবস্তুর ধ্বংসস্তূপ।
পূর্ণচন্দ্রের অনুসন্ধান যে নির্ভুল, সে-বিষয়ে সকলেই একমত হয়েছেন। এমনকি ওয়াডেল নিজেও সম্মতি জানিয়েছেন। ভারতবর্ষের ইতিহাস বদলে দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব। আর তাঁর হারিয়ে যাওয়া রাজধানী খুঁজে বের করেছিলেন বাবু পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। এদেশের ইতিহাস লেখার কাজ তো শুধু সাহেবরাই করেননি। সমানতালে কাজ করে গিয়েছেন ভারতীয়রাও। স্মরণীয় বাঙালিদের নাম বললে, তাঁর উল্লেখ করবেন না অনেকেই। কিন্তু তাঁকে ছাড়া ভারতের নৃতত্ত্ব গবেষণা সংস্থার দুটো বড়ো কৃতিত্বই অধরা থেকে যেত।
তথ্যসূত্র: প্রত্নতথ্য, প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত
Powered by Froala Editor