ভুবনেশ্বরকে ‘টেম্পল সিটি’ বলা হয়। তবে দেখতে গেলে, উত্তরপ্রদেশে মন্দিরের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বারানসি, কানপুর, ইলাহাবাদ-সহ প্রায় সর্বত্রই অলিতে গলিতে দেখা মেলে মন্দিরের। মানুষের ভিড়ও নেহাত কম থাকে না সেখানে। ফলে দিনের শেষে উৎপন্ন হয় বিপুল পরিমাণ জৈব বর্জ্য। যা মূলত ফুল। অবশ্য এই পুষ্পবর্জ্যকে সাধারণ আবর্জনার সঙ্গে মেশানো হয় না। পবিত্রতার খাতিরেই তাদের জায়গা হয় গঙ্গায়। ফেলে দেওয়া এই ফুলের পচন এবং তাতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ক্রমশ দূষিত করে তুলছে গঙ্গাকে। অথচ, তা নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা নেই কারোরই। এবার এই সমস্যারই অভিনব সমাধান খুঁজে বার করেছে কানপুরের একটি স্টার্ট আপ সংস্থা ‘ফুল’ (Phool)। ফুলের বর্জ্যকে কাজে লাগিয়েই তারা তৈরি করে ফেলেছে জৈব লেদার।
হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি। ফুল থেকে তৈরি এই জৈব চামড়া বাজারে পরিচিত ‘ফ্লেদার’ (Fleather) নামে। অবশ্য ‘ফ্লেদার’-এর জন্ম কানপুরে নয়। ইউরোপ ও আমেরিকায় ‘ভেগান’ মতবাদ জনপ্রিয়তা লাভের পর থেকেই শুরু হয়েছিল চামড়ার বিকল্প-সন্ধানের প্রক্রিয়া। মস, ফার্ন ও শাক-সবজির অবশিষ্টাংশ দিয়েই পশ্চিমি গবেষকরা বানিয়ে ফেলেছিলেন এই জৈব চামড়া। যা বাজারে উপলব্ধ বহু আগে থেকেই।
কৃত্রিম জৈব চামড়া উৎপাদনের এই প্রক্রিয়ায় খানিক বদল এনেছে কানপুরের স্টার্টআপটি। অন্যান্য জৈব বর্জ্যের বদলে তারা ব্যবহার করছে ফুল। তবে আজ নয়, ‘ফুল’-এর পথ চলা শুরু হয়েছিল ২০১৫ সালে। নেপথ্যে রসায়নের ছাত্র অঙ্কিত আগরওয়াল। কানপুরের গঙ্গার ধারে প্রাতঃভ্রমণে করতে গিয়েই আশ্চর্য এক দৃশ্য নজরে এসেছিল তাঁর। গঙ্গার ধারেই বর্জ্য ফুল জমে রীতিমতো পাহাড়ের রূপ নিয়েছে। একদিকে যেমন তা পচে গিয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে বায়ুতে, তেমনই নদীর জলেও মিশছে এইসকল ফুল উৎপাদনে ব্যবহৃত রাসায়নিক। রসায়নের ছাত্র হওয়ায় অঙ্কিতের বুঝতে অসুবিধা হয়নি, যে দুর্গন্ধের সঙ্গে এক্ষেত্রে মিথেনের মতো গ্যাসও ছড়াচ্ছে প্রকৃতিতে।
না, হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি অঙ্কিত। বরং, এই পুষ্পবর্জ্যের কীভাবে পুনর্ব্যবহার করা যায়, তা নিয়েই শুরু করেছিলেন গবেষণা। কানপুর আইআইটিরও সমর্থন পেয়েছিলেন তিনি। সেটা ২০১৭ সাল। এই জৈব প্রাথমিকভাবে ধূপকাঠি তৈরির মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল ‘ফুল’-এর পথ চলা। তবে তাতে কি আর এই বিপুল পুষ্পবর্জ্যের প্রকিয়াকরণ সম্ভব? তাই বিকল্পের অনুসন্ধান জারি রেখেছিলেন অঙ্কিত।
পরবর্তীতে তাঁর নজর কাড়ে বাজার চলতি জৈব বা ‘ভেগান’ লেদার। এরপর আইআইটি কানপুরের গবেষক নচিকেত কুন্তলার কাছে দ্বারস্থ হন অঙ্কিত। যৌথ উদ্যোগেই প্রস্তুত করেন এক বিশেষ মাইক্রোবিয়াল সলিউশন। যা অনায়াসেই ফুলকে পরিণত করবে চটচটে, আঠালো একটি পেস্টে। যা শুকালে পরিণত হয় জৈব চামড়ায়। ইউরোপে ভেগান লেদার তৈরিতে যে ধরনের রাসায়নিক ব্যবহৃত হয়, তার থেকে চারিত্রিক দিক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এই জৈব বিক্রিয়ক। ফলে, তা থেকে দূষণেরও আশঙ্কা নেই কোনো।
২০২১ সাল থেকে ‘ফ্লেদার’-খ্যাত এই জৈব চামড়া উৎপাদন করে চলেছে কানপুরের সংস্থাটি। তা দিয়ে তৈরি স্লিং ব্যাগ, ওয়ালেট, বেল্ট ও অন্যান্য সামগ্রী ইতিমধ্যেই বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে ভারতীয় বাজারে। সেইসঙ্গে ‘ফুল’-এর বিনিয়োগকারীদের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন আলিয়া ভাটের মতো তারকারাও। চাকরি পেয়েছেন গ্রামের বহু তরুণ-তরুণী। সবমিলিয়ে অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত দিক থেকে বড়ো পরিবর্তন নিয়ে এসেছে কানপুরের এই সংস্থা। অন্যদিকে এই উদ্যোগের সৌজন্যে কমছে চামড়া উৎপাদনের জন্য পশুহত্যার মাত্রাও। অর্থাৎ, বলতে গেলে অঙ্কিতের এই উদ্যোগ এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতোই…
Powered by Froala Editor