তাঁর জন্মের আগেই হয়ে গেছে ওয়াহাবি আন্দোলন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়েই ক্রমশ থিতিয়ে পড়েছে তার ঢেউ। কৈশোরে টের পেয়েছিলেন সাঁওতাল বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহের প্রভাব। প্রত্যক্ষ না হলেও মীর মশাররফ হোসেনের (Mir Mosharraf Hossain) জন্মস্থান কুষ্টিয়াতেও এসে পৌঁছেছিল বাংলাব্যাপী একাধিক কৃষক আন্দোলনের রেশ। বাংলার সামাজিক প্রেক্ষাপটে একদিকে যেমন গড়ে উঠছিল ‘মহামেডান লিটারেরি সোসাইটি’, ‘ঢাকা মুসলমান সুহৃদ সম্মিলনী’, ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্যসমিতি’। তেমনই ‘হিন্দুমেলা’, ‘গো রক্ষিণী সভা’-এর মতো সভা-সমিতির উত্থান উভয়ধর্মের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের পার্থক্যকে চিহ্নিত করছিল বহুভাবে। এর সঙ্গে ছিল বাংলার অর্থনীতির জটিল পরিস্থিতি। গ্রামের প্রাচীন জমিদারতন্ত্রের পাশাপাশি শহরে শুরু হয়েছে নব্যধনতন্ত্রের জয়গান।
মীর মশাররফ হোসেনের পরিবারও ছিল জমিদার। চিরাচরিত উচ্ছৃঙ্খলতা বাসা বেঁধেছিল তাঁদের রক্তে। অথচ তিনি নিজে লিখেছিলেন ‘জমীদার দর্পণ’-এর মতো নাটক। মুসলিম জমিদারের শরীরী লোলুপতা কীভাবে গ্রামবাংলার সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনকে দূষিত করেছিল, তা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় এই নাটক। আবার ‘গো-জীবন’ প্রবন্ধ লিখে তাঁকে জড়িয়ে পড়তে হয় মামলায়। ধর্মীয় সহিষ্ণুতা বজায় রাখার জন্য নিজের ধর্মের মানুষদের থেকে যেটুকু আত্মত্যাগ দাবি করেছিলেন, তার ফল পেয়েছিলেন হাতেনাতে। তাঁর নিজের দৃষ্টিভঙ্গিও যে ইংরেজি শিক্ষা ও নবাগত চেতনা সম্পর্কে উদার ছিল, তা বলা যাবে না। তবে উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ সর্বত্রই সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে মানবতাকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন তিনি। মশাররফ হোসেন সম্পর্কে বাংলা সাহিত্যে যে সামান্য আলোচনা আজও অবশিষ্ট আছে, তা মূলত এই সাহিত্যকর্ম নিয়ে। তুলনায় একেবারেই কথা হয় না তাঁর বাউলগান সম্পর্কিত কাজ নিয়ে।
১৮৬৫ সালে তিনি ‘গ্রাম্যবার্তা প্রবেশিকা’-র সম্পাদক কাঙাল হরিনাথ বা হরিনাথ মজুমদারের সংস্পর্শে আসেন। যোগাযোগ হয় ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর সহকারী সম্পাদক ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও। তার আগের দুবছর চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলতায় কেটেছে মশাররফের জীবন। কুসঙ্গে জড়িয়ে বিপথে পা বাড়িয়েছিলেন। বন্ধ হয়ে গেছিল পড়াশোনা। হরিনাথ ও ভুবনচন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ যেন তাঁকে নতুন পথের সন্ধান এনে দেয়। মশাররফের বয়স তখন মাত্র ১৮। ‘আমাদের কুষ্টিয়ার সংবাদ দাতা’ পরিচয়ে সাদামাটা খবর লিখে পাঠিয়ে দিতেন ‘প্রভাকর’-এর দপ্তরে। কেউ জানত না তাঁর আসল নাম। সাংবাদিকতার পাশাপাশি কাঙাল হরিনাথের আবেদনে সাড়া দিয়ে ‘গ্রাম্যবার্ত্তা’-এর জন্য বিভিন্ন ঘটনার বিপোর্ট লেখা শুরু করলেন। এখানে তাঁর ছদ্মনাম ‘গৌরীতটবাসী মশা’। সেই অঞ্চলের মুসলমানদের কিছু গোঁড়ামি নিয়ে লেখা ‘মুসলমানের বিবাহ পদ্ধতি’ ও ‘গোলাপ’ কবিতাটি নিয়ে বিতর্কও হয়। এরপর কাঙাল হরিনাথ তাঁকে এক অদ্ভুত অনুরোধ জানান। বাউল গানের জন্য যথেষ্ট খ্যাতি ছিল হরিনাথের। ‘ফিকিরচাঁদের দল’ নামে নিজের একটি সংগঠনও ছিল। এমনকি লালন ফকির বহুবার এসেছেন কাঙালের দুয়ারে। তিনি মশাররফকে বললেন সেই দলে যুক্ত হতে।
প্রথমে খানিক আপত্তি জানালেন তিনি। গান লিখতে পারেন, লালনের প্রভাবও রয়েছে তাঁর চেতনায়। কিন্তু গান গাওয়াটা একেবারেই আসে না। একদিন কুমারখালিতে কাঙালের বাড়িতে উপস্থিত মশাররফ। অনুরোধ জানালেন পুরো ‘ফিকিরচাঁদের দল’-কে তাঁর বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণের। কিন্তু বেঁকে বসলেন কাঙাল হরিনাথ। অতিথি হওয়া তো দূরের কথা, সামান্য তামাকও গ্রহণ করবেন না তাঁরা। কারণ, দলের লোকের বাইরে কারোর বাড়িতে থাকার নিয়ম নেই তাঁদের। থাকতে পারেন, যদি মশাররফ দলে যোগদান করেন। গান গাইতে না পারলেও, লিখতে তো জানেন। যদি এখানে বসে গান লিখে দেন, তবে অবশ্যই সকলে মিলে যাবেন মশাররফের বাড়িতে। সেখানে বসেই গান লিখলেন তিনি,
আরও পড়ুন
বাউলের আখড়ায় দেখা ‘বড়োলোকের বিটি’কে, স্মৃতিতে বুঁদ স্রষ্টা রতন কাহার
“রবে না চিরদিন,
সুদিন কুদিন একদিন দিনের সন্ধ্যা হবে।”
আরও পড়ুন
অজয়ের ঢেউ, মাঘের শীত আর বাউল গান মিলেমিশে যায় কেঁদুলির জয়দেবে
ব্যাস, আর কোনো বাধা রইল না অতিথি হওয়ার।
এরপর একাধিক বাউল গান লেখেন মশাররফ। তবে স্বাভাবিকভাবেই সেই গানে কোনো গুহ্য তত্ত্ব নেই। তিনি বাউল সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন না, সাধনতত্ত্বের কাজকর্মের সঙ্গেও কোনো সম্পর্ক ছিল না। হরিনাথ ও লালনের জীবনদর্শনের প্রভাবকেই তিনি ধারণ করেছিলেন গানে। অনিত্য এই জীবনে মানুষের লোভ-লালসার ব্যর্থতা ধরে পড়ে সেখানে। যেমন,
“কে বা কার, তুমি বা কার, কে বা তোমার;
চিনলে না মন, মনের ফেরে।”
লালনের গানের সঙ্গে যথেষ্ট সাযুজ্য পাওয়া যায় এই উচ্চারণে। কিংবা সংসারের শূন্যতার ভয় থেকে ‘মশা বাউল’ লিখছেন, “ঐ ছয় চোরের ফেরে, এবার পড়ে/ ঘরে কিছু রহিল না।” জাত-ধর্মের সংকীর্ণ ভেদকে অস্বীকার করে তাঁর গান। কখনও-বা আক্রমণ করে বসেন মৌলবি-পুরোহিতদের, “মশা কয়, ধোকায় পড়ে বোকা হয়ে/ করি আমরা মারামারি।” আবার বাউল সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আপত্তি ছিল তাঁর। ফলে ‘ফকিরচাঁদের দল’-এ নিজেকে সম্পূর্ণভাবে খুঁজে পেয়েছিলেন, তা বলা যাবে না। নিজেও জানতেন যে এই পার্থক্যের জন্য বাউল সম্প্রদায়ের কণ্ঠে কখনই জনপ্রিয়তা পাবে না তাঁর গান। নিজের সীমাবদ্ধতার কথাও জানতেন। তা সত্ত্বেও নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন গান রচনায়। আর সেই কারণেই লিখেছিলেন,
“ফিকির চাঁদে, আজব চাঁদে,
রসিক চাঁদে সব মেতেছে।
কোথা আর পাগলা কানাই, লালন গোঁসাই
সব সাঁই এতে হার মেনেছে।”
Powered by Froala Editor