উইয়ের ঢিবি, না মনুষ্যবসতি? ইরানের আশ্চর্য গ্রামের গল্প

দূর থেকে দেখলে অবিকল উইয়ের ঢিবির মতো। যদিও উই নয়, ঢিবিগুলি মানুষের। উত্তর-পশ্চিম ইরানের (Iran) পাহাড়ি কোলে এক ঐতিহাসিক প্রত্যন্ত গ্রাম কান্দোভান (Kandovan)। আধুনিক যুগেও এখানকার বাসিন্দারা ঢিবির মতো গুহায় থাকেন।

'কান্দোভান' নামটি ফার্সি শব্দ 'কান্দো' থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ স্থানীয় তুর্কি উপভাষায় 'করণ'। যার অর্থ মৌচাক। বাড়িগুলির ডাকনাম 'করণ'। হাজার হাজার বছর আগে এখানে এক আগ্নেয়গিরির ঘুম ভাঙে। নির্গত লাভা ঠান্ডা হওয়ার পর অঞ্চলটিতে উষ্ণ ঢিবির জন্ম।

প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে জানা যায়, কান্দোভানের ইতিহাস ১০ হাজার বছরেরও বেশি সময় আগের। অঞ্চলটিতে প্রথম বসতি স্থাপন করে প্রাগৈতিহাসিক মানুষেরা। কান্দোভানের আশপাশের অঞ্চলে সহস্রাব্দ ধরে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের বসবাস। এর মধ্যে মেডিস, অ্যাকেমেনিডস, পার্থিয়ান, সাসানিড অন্যতম। গোষ্ঠীগুলি তাদের ব্যবহার্য জিনিস, মৃৎপাত্র কিংবা অন্যান্য শিল্পকর্মের মধ্যে রেখে গেছে তাদের সভ্যতার চিহ্ন।

সময় ছুটে চলে। সময়ের সঙ্গে ছুটতে ছুটতে এই এলাকায় বাড়ে জনবসতি। প্রসারিত হয় গ্রাম। পরিবারগুলির প্রয়োজনেই আবশ্যিক হয় গুহাবাড়ির সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন। গ্রামবাসীরা পানীয় ও সেচের জন্য নিকটবর্তী ঝরনা থেকে জল গ্রামে আনার জন্য তৈরি করে জলের চ্যানেল।

আরও পড়ুন
ইরানের বুকেই লুকিয়ে একটুকরো পাঞ্জাব 'জাহিদান'!

তখন ইসলামি স্বর্ণযুগ। কান্দোভানের আশপাশের অঞ্চলটি বৃত্তি ও শিক্ষার আদর্শ কেন্দ্র। পণ্ডিত-দার্শনিকদের কাছেও তাই প্রিয় ছিল এই এলাকা। ১১ এবং ১২ শতকে সেলজুক তুর্কিরা এই অঞ্চলে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। কান্দোভান সম্ভবত বাণিজ্যপথ সিল্ক রোডের নিকটবর্তী হওয়ায় বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ। এর পর থেকে কান্দোভান অনেক উল্লেখযোগ্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে, বিশেষ করে ২০ শতকে। এই সময় নগরায়ণের ফলে কান্দোভান অনেক বেশি আধুনিক হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন
বইয়ের নামে রাস্তার নামকরণ! পথ দেখাচ্ছে ইরান

স্থানীয়দের দাবি, প্রায় সাতশো বছর আগে কিছু মানুষ মঙ্গোল হানাদারদের হাত থেকে বাঁচতে এই টিলাগুলোতে বসতি স্থাপন শুরু করে। আর এখন? ইরানের তাবরিজ শহরের কাছে পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের প্রাচীন এই গ্রাম বহরে বেড়েছে। প্রায় সাড়ে ছ'শো মানুষের নিবাস কান্দোভানে। এখানকার মানুষের আয়ের উৎস কৃষি ও ভেড়া পালন। ভালো আয় আসে শুধুমাত্র পর্যটন থেকেও। হস্তশিল্প তৈরি করে বিক্রিও করেন তাঁরা। নিবাসীদের প্রচেষ্টায় একেকটা বাড়ি এখন হেরিটেজ হোটেল। ঘরগুলি শীতকালে উষ্ণ এবং গ্রীষ্মে শীতল। এমনটা কীভাবে সম্ভব? ঘরগুলির দেওয়াল প্রায় দুই মিটার পুরু। মেদবহুল এই দেওয়ালই গ্রীষ্মে শীতল বাতাস প্রবাহিত করে এবং শীতকালে উষ্ণ বাতাস আটকে রাখে। বছরের যে-কোনো সময়েই ঘরগুলিতে থাকা আরামদায়ক।

কান্দোভানের ঢিবির মতো গুহাবাড়িগুলির অনন্য নকশা এবং নির্মাণ গ্রামের প্রধান আকর্ষণ। ঘরগুলি আগ্নেয়গিরির ছাই ও শিলা কেটে এমনভাবে তৈরি, যা নিয়েছে শঙ্কু আকৃতি। বাসিন্দাদের নিবিড় শ্রম ও ধৈর্য না থাকলে এমন শৈলীর ঘর বানানো অসম্ভব। দরজা খুলে একচিলতে ঘরটায় ঢুকে বাইরেটা দেখলে মনে উঠবে খুশির তুফান। না, কেবল বাইরে নয়, ঘরের ভিতরটাও পাল্লা দিয়ে পরিপাটি। মেঝেতে পাতা কার্পেট, ঐতিহ্যশালী কম্বল, কুশন, কাঠ-পোড়া চুলা, রঙিন ট্যাপেস্ট্রি বা পর্দা দেখে মন ছুঁয়ে যাবেই।

কান্দো-'করণ'গুলির বেশিরভাগই দোতলা। যদিও সেগুলি কিছু ক্ষেত্রে তিন, এমনকী চার তলাও। ভিতর থেকে একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় ঘরগুলি। গ্রামীণ মানুষ এই পাহাড়ের মধ্যে কেবল আবাস নয়, তৈরি করেছে চারণভূমি, গুদামসহ নানান কর্মশালাও। মাল্টি-স্টোর হাউস এবং সিঁড়িগুলি সাধারণত প্রতিটি তলের সঙ্গে অন্য তলের সংযোগের জন্য তৈরি।

গ্রামটিতে রয়েছে গণশৌচালয়, জলের কল, স্কুল, মসজিদসহ সমস্ত সুবিধা। মসজিদটি কান্দোভানের বৃহত্তম করণগুলির মধ্যে একটি। বাড়িগুলির অনন্য স্থাপত্য, সুন্দর উপত্যকা, মনোরম আবহাওয়া, জৈব দুগ্ধ, বাদাম ও ঔষধি গাছ, মধু এবং কারুশিল্প অঞ্চলটিকে ইরানের অন্যতম পর্যটন অঞ্চলে পরিণত করেছে। কান্দোভানের বাড়িগুলি ভূমিকম্প-প্রতিরোধী। কারণ প্রাকৃতিক এই শিলা শক্তিশালী এবং নমনীয়। গ্রামে রয়েছে রোগা গলির গোলকধাঁধা। ইতিহাস, স্থাপত্য এবং প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে কান্দোভান নির্বিকল্প।

Powered by Froala Editor