ওয়েলিংটনের মোড়ে দাঁড়িয়ে ভেজাল তেলে ভাজা হাঁসের ডিমের ওমলেট চেটেপুটে খাচ্ছেন কমলকুমার, আর খুব তারিফ করছেন। কাঁচালঙ্কার ঝালটি বেড়ে হয়েছে তো, আহা। “বঁ, সে বঁ।” বলাই বাহুল্য, এই ‘বঁ, সে বঁ’-টি বাংলা ভাষার কোনও প্রয়োগ নয়। আদ্যন্ত ফরাসি। কিন্তু এমন বিজাতীয় কথা শুনেও দোকানি চমকে যান না, কমলকুমারের সঙ্গীসাথিরাও চমকান না। কারণ বাংলার মাঝে এমন ফরাসি অনুপ্রবেশে তাঁদের কান ইতিমধ্যেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। নিখাত কলকাত্তাইয়া বাংলার মাঝেই এমন এক-দু’চুমুক ফরাসি গদ্য মিশিয়ে দেন কমলকুমার। এসব তাঁকে দিব্বি মানায়।
আর কমলকুমারকে ঘিরে ভিড় জমান ফরাসি ভাষা শিখতে উৎসাহী যুবক-যুবতীরা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো অনেকেই আছেন এই দলে। ফ্রান্স তো স্বপ্নের দেশ। সেখানে থরে-বিথরে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের বাস। ফরাসি ভাষাটাও চুম্বকের মতো টানে। ফরাসি ভাষাবিদ আরও একজন আছেন কলকাতায়। বুঢঢা, মানে সিগনেট প্রেসের তৎকালীন অংশীদারদের অন্যতম সুনন্দ গুহঠাকুরতা। তিনি বহুভাষাবিদ। গ্রিক-সহ প্রায় পনেরো-ষোলোটি ভাষা নাকি তিনি জানেন। কিন্তু ফরাসি শিখতে গেলে কমলকুমারের কাছে না এসে যেন উপায় নেই। কমলকুমারের আকর্ষণই আলাদা। তিনি কলেজ স্ট্রিট বা ওয়েলিংটন মোড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আলোচনা করতে পারেন সাহিত্য-দর্শনের নানা মণি-মুক্তো নিয়ে। সঙ্গে গিরিশচন্দ্র, অর্ধেন্দুশেখর, শিশির ভাদুড়ির মতো গণ্যমান্য মানুষদের সম্পর্কে বিবিধ গল্প-অ্যানেকডোট। পরনে ধবধবে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি, বলিষ্ঠ চেহারা, ব্যাকব্রাশ করা চুল। দেখলেই একটা চোরা আকর্ষণ ঘন হয়। বসতে তাঁকে কদাচিৎ কেউ দেখেছে হয়তো। আর সদা দণ্ডায়মান অবস্থায় তাঁর সেই আলোচনা বা গল্প যাঁরা শুনেছেন, তাঁদের বুঁদ না হয়ে উপায় নেই।
কমলকুমারের লেখা বাংলা গদ্য নেহাত সহজপাচ্য নয়। কিন্তু তাঁর মুখের গদ্য ছিল খাঁটি কলকাতার চলতি ভাষায় গড়া, সুনীল বলেছেন ‘কলকাতার ককনিও’। চলতি বাংলা বুলির খাঁজে খাঁজে মিশে ফরাসি আতর। কোনও এক তরুণ কবিকে স্নেহভরে ভর্ৎসনা করতে করতে বলছেন, “কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না বুঝলে! পভর পোয়েত ব্রাভাইয়ো।” হাতে সবসময় একখানা করে ফরাসি ক্লাসিক। বাসে-ট্রামে যাতায়াতের সময় সেই বই উঠে আসত মুখের সামনে আবার প্রয়োজনে সেই বই-ই তাঁর মানিব্যাগ। পাতার খাঁজে খাঁজে নোট। রেস্তোরাঁয় কিংবা পানশালায় টাকা দেওয়ার সময়েও বইয়ের পাতা ওল্টাতেন কমলকুমার। মেজাজটাই তাঁর আসল রাজা। ইংরেজদের নাকি বিশেষ পছন্দ করতেন না, শোনা যায় ইংরেজ-মনস্ক বাঙালিরা ছিল তাঁর উপহাসের পাত্র। ফরাসি ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি তাঁর প্রিয় বিষয়। আড্ডা বা আলোচনায় প্রায়ই বলতেন, বাংলা গদ্য ইংরেজি সিনট্যাক্স-নির্ভর না হয়ে ফরাসি গদ্যের আদর্শে তৈরি হলে আরও মধুর হত। সংস্কৃত টোলে পড়াশোনা করা, তারপর ওস্তাদের কাছে সেতারে তালিম নেওয়া মানুষটা একদিকে অত্যন্ত ভারতীয় আর্য, অন্যদিকে ফরাসি সংস্কৃতির গভীর অনুরাগী।
অথচ এই মানুষটিই কোনওদিন পা রাখেননি দেশের বাইরে। চাইলেই যেতে পারতেন। তাঁর ভাই শিল্পী নীরোদ মজুমদারই দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন ফ্রান্সে। কিন্তু কমলকুমারের ইচ্ছেই হয়নি বিদেশ যাওয়ার। আশ্চর্য মানুষ! সুনীল লিখছেন, কেউ যদি বিদেশ থেকে ফিরে বেশি সাহেবিপনা দেখাত, তাহলে হেসে ফেলতেন কমলকুমার। হাসতে হাসতেই বলতেন, “আমার বাবার বাবার বাবার বাবা হাফ প্যান্টুল পরে বিলেত গেসলো বুঝলে!” কমলকুমার বিদেশ না-ই বা গেলেন, বিদেশ থেকে অনেক পণ্ডিত-জ্ঞানী-গুণী মানুষরা কলকাতায় এলে তাঁর খোঁজ করতেন। কমলকুমার তাঁদের ডেকে নিতেন খালাসিটোলার দেশি মদের ঠেকে। চারপাশে আধো-অন্ধকার, দেশি বাংলার গন্ধ, টলোমলো মানুষ আর ময়লার মধ্যেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাঁদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় মাততেন কমলকুমার। সেই আলোচনায় হয়তো নেশা লেগে যেত কল্লোলিনী তিলোত্তমারও।
ডেভিড ম্যাকাচ্চিয়ন তখন টেরাকোটা মন্দির নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে বাংলার গ্রামে-গঞ্জে ঘুরছেন। গবেষণার জন্য সাহায্য চাইতে প্রায়ই তিনি সত্যজিৎ রায় আর কমলকুমারের কাছে আসতেন। মাঝে বেশ কিছুদিন তাঁর দেখা নেই। কমলকুমার একদিন সত্যজিৎকে জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা, ওই ফর্সা মতো ভদ্রলোকের সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছে এর মধ্যে?’’ সত্যজিৎ বুঝতেই পারেন না কোন ‘ফর্সা মতো’ ভদ্রলোকের কথা বলা হচ্ছে। অনেক কষ্টে যখন বোঝা গেল ম্যাকাচ্চিয়ন-এর কথা বলছেন কমলকুমার তখন সত্যজিৎ বেজায় অবাক। “ফর্সা ভদ্রলোক কী? ও তো সাহেবই!” কমলকুমার স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে উত্তর দিলেন, “ওই হল!’’
সত্যজিৎকে নিয়ে খানিক বিশেষ দুর্বলতা ছিল অবশ্য। একদিন অ্যাম্বাসাডর থেকে সত্যজিৎকে নামতে দেখে বলেছিলেন, “আজ সত্যজিৎকে নামতে দেখলাম। অ্যাম্বাসাডর থেকে নামছেন তো নামছেন তো নামছেন...” দীর্ঘাকায় সত্যজিৎ যেন ময়াল সাপ। সত্যজিতের সমালোচনা শুনলে নাকি রেগে যেতেন। একজনকে একবার বলেছিলেন, “ছি! ছি! নেবু গাছের তলে দাঁড়িয়ে সত্যজিতের নিন্দে করলে নেবু তেতো হয়ে যাবে।” সত্যজিৎও গুণমুগ্ধ ছিলেন কমলকুমারের। ‘পথের পাঁচালী’-র একটি পুজোর আচারবিধিতেও সামান্য ত্রুটি খুঁজে পেয়েছিলেন কমলকুমার। যে ত্রুটি আর খুব বেশি মানুষের যে চোখে পড়েনি, বলাই বাহুল্য।
আরও পড়ুন
‘কলকাতা শহরটা আমার, ফিরে গিয়ে ওখানে রাজত্ব করব’ – বিদেশ থেকে চিঠি এল সুনীলের
এহেন কমলকুমারের কাছে ফরাসি শিখতে আসতেন অনেক তাবড় তাবড় মানুষই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়রাও আবদার জুড়লেন ফরাসি শিখবেন।
কমলকুমার রাজি। তবে শর্ত আছে দু’খানা—এক, মাইনে দিতে হবে মাসে একটাকা আর তাঁর অনুমতি ছাড়া প্রকাশ্যে অন্যদের কাছে একটাও ফরাসি বাক্য উচ্চারণ করা যাবে না। শিক্ষার লোভে তাতেই রাজি হন সুনীল অ্যান্ড কোং। উত্তর কলকাতার গ্রে স্ট্রিটে আশুতোষ ঘোষের বাড়িতে সপ্তাহে দু’দিন দুপুরে বসত ফরাসি ক্লাস। সে নাকি ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। শিক্ষক কমলকুমার অত্যন্ত কঠোর, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে শব্দরূপ-ধাতুরূপ মুখস্ত করতে হত। সেই অত্যাচারে মাস দুয়েকের মধ্যেই ফরাসি শেখার মোহ চলে গেল। কিন্তু কমলকুমারকে ঘিরে মুগ্ধতায় কোনও চিড় ধরেনি সুনীলের। কমলকুমার তাঁর ‘মোশান-মাস্টার’। তাঁরই নির্দেশনায় সুকুমার আর রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চস্থ করেছেন সুনীল-শক্তি। তাঁকে ঘিরে কত ঘোর ঘন হয়েছে। তাই হয়তো সুনীল অনায়াসে বলতে পারেন- “কমলকুমার আমাদের প্রথম যৌবনের অ্যারিস্টটল।”
আর, কলেজ স্ট্রিট বা ওয়েলিংটনের মোড়ই ছিল সেই আথেনসের লাইসিয়াম। ডিমভাজা খেতে-খেতে বা চায়ের ভাঁড় হাতে দাঁড়িয়ে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত একজন সুপুরুষ গল্প বলছেন। গল্পের মাঝে ঢুকে পড়ছে পাণ্ডিত্যের আলো। আলো ক্রমে আসিতেছে আর উজ্জ্বল হয়ে উঠছে চারপাশ। কমলকুমার ঘোর বুনছেন।
আরও পড়ুন
‘পথের পাঁচালি’রই কি প্রত্যুত্তর পাই কমলকুমারের ‘সুহাসিনীর পমেটম’-এ!
তথ্যঋণ- 'ছবির দেশে, কবিতার দেশে', সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স; 'কমলকুমার সরণি', শংকরলাল ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩ অক্টোবর, ২০১৪।
Powered by Froala Editor