মা ও দাদুর সঙ্গেই ভারত চেনা, মার্কিন উপরাষ্ট্রপতি কমলা হ্যারিসের শৈশব কেটেছে এদেশেও

চেন্নাইয়ের বেসান্ত নগর। ভোরবেলায় সমুদ্রসৈকতে দাদুর হাত ধরেই হেঁটে চলেছে ছোট্ট কিশোরী। তবে তাঁর স্থায়ী ঠিকানা একেবারেই চেন্নাই নয়। যুক্তরাষ্ট্রেই তার বাড়ি, সেখানেই স্কুল, পড়াশুনো।  কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে রয়েছে এই ভারতীয় শহরেই। আর সেই মাটির টানেই মায়ের সঙ্গে ঘুরতে আসা মামাবাড়িতে। সেদিনের সেই ছোট্ট কিশোরীই আজ উপ-রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে বসতে চলেছে যুক্তরাষ্ট্রের। দায়িত্ব নিতে চলেছে প্রথম অ-শ্বেতাঙ্গ মহিলা হিসাবে। তৈরি করছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক নতুন ইতিহাস।

হ্যাঁ, কমলা হ্যারিস। ছোটোবেলায় বছর দুয়েক ছাড়া-ছাড়াই মায়ের সঙ্গে ভারতে চলে আসতেন তিনি। আর এদেশে আসার সবথেকে আকর্ষণ ছিল দাদুর সঙ্গ পাওয়া। সকাল বেলায় দাদুর সঙ্গে হাঁটতে বেরিয়েই চেনা হয়ে যেত দেশটাকে। দেশের সমাজ, অর্থনীতি, গতি-প্রকৃতিকে। কারণ দাদু পিভি গোপালান ছিলেন ভারত সরকারের শ্রম, কর্মসংস্থান এবং পুনর্বাসন মন্ত্রকের জয়েন্ট সেক্রেটারি। পরে জামবিয়ায় ভারতের প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করেছেন রিলিফ মেসার অ্যান্ড রিফিউজি দপ্তরের ডিরেক্টর হিসাবে। তখন নেহরুর জমানা। সেইসব সকালগুলোয় নাতনিকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়ে বন্ধুদের সঙ্গেও আড্ডা জমাতেন তিনি। কথার প্রসঙ্গে উঠে আসত সাম্যাধিকার, দুর্নীতি কিংবা জটিল বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয়। তবে শুনতে মন্দ লাগত না কমলার। বরং এক অন্য উদ্যম পেতেন তিনি। ধীরে ধীরে দাদুই হয়ে উঠেছিলেন তাঁর আদর্শ পুরুষ। অন্যদিকে কমলার মা-ও ছিলেন তাঁর অনুপ্রেরণা।

মা শ্যামলা হ্যারিস ভারত থেকেই পাড়ি দিয়েছিলেন মার্কিন প্রদেশে। উদ্দেশ্য ছিল এন্ডোক্রিনোলজি নিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ। এদিকে দেশে পরিবার ঠিক করে রেখেছিলেন বিবাহের সমস্ত বন্দোবস্তই। কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই তিনি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লেন যুক্তরাষ্ট্রের এক যুবকের সঙ্গে। ডোনাল্ড হ্যারিস। তবে যুক্তরাষ্ট্র বলা ভুল হবে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশ জামাইকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করতে গিয়েছিলেন তিনিও। বিষয় ছিল অর্থনীতি। বাড়িতে নিজের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েই হ্যারিসকে বিয়ে করেন শ্যামলা। 

তবে পড়াশোনার পাশাপাশি সেসময় শ্যামলা হ্যারিস হয়ে উঠেছিল মার্কিন আন্দোলনের এক অন্যতম অঙ্গ। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকতার অধিকারের জন্য লড়াই। সেইসঙ্গে বর্ণবৈষম্য তো ছিলই। এই সবকিছুর বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। 

যুক্তরাষ্ট্রেই জন্ম কমলার। ১৯৬৪ সালে। ছোট থেকেই তাঁর ওপর প্রভাব ফেলেছিল মায়ের প্রতিবাদী সত্তা। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পর মায়ের কাছেই কুইবেক শহরে মানুষ কমলা। মার্কিন সংস্কৃতি তো ছিলই, সেইসঙ্গে হারিয়ে যায়নি ভারতীয় শিকড়ও। মেহেন্দি হোক কিংবা খাবার, ভারতীয় চালচলন মিশে তাঁর রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

২০০৪ থেকে ২০১১ সাল অবধি ছিলেন সান ফ্রান্সিসকোর ডিসট্রিক্ট অ্যাটর্নি। ২০১১ সালে অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্বে পদাসীন হন কমলা। তারপর সেনেটের চেয়ার। সানফ্রান্সিসকোর হিংসাত্মক মনোভাবকে খর্ব করা থেকে বিভিন্ন সময়ে অনৈতিক যে কোনো কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধেই সরব হয়েছিল ভারতীয় বংশোদ্ভুত কমলা। একাধিকবার ট্রাম্পের বিরুদ্ধে তো বটেই, এমনকি ছাড়েননি স্বয়ং বাইডেনের নীতিকেও সমালোচনা করতে। তবে শেষ অবধি ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসাবে তাঁকেই বেছে নেন জো বাইডেন। বৈষম্য, অভিবাসীদের হয়ে গলা ফাটানোর মতো সৎ ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর বিকল্প কমলা ছাড়া আর কেই বা ছিল?

আরও পড়ুন
অবশেষে প্রতীক্ষার অবসান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট বাইডেন

তবে প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশনে এই প্রথম নয় কমলা হ্যারিস। বছর চারেক আগে খোদ রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হিসাবে ছিল তাঁর দাঁড়ানোর পরিকল্পনা। প্রচার শুরু করেও শেষ অবধি পিছিয়ে এসেছিলেন তিনি। শুধুমাত্র আর্থিক সঙ্গতি না থাকায়। ‘লেডি ওবামা’-খ্যাত কমলার জায়গায় শেষ অবধি লড়েছিলেন ক্লিনটন। 

তবে তাঁর কাঁধে মার্কিন প্রশাসনের এত গুরুদায়িত্ব থাকার পরেও, ভারতীয় নাড়ির যোগ বিচ্ছিন্ন করেননি কমলা। ২০০৯ সালে মায়ের মৃত্যুর পরও এতটুকু বদলায়নি সেই সম্পর্ক। প্রায়শই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাই সেলফোন টাওয়ার খুঁজে নেয় আট হাজার কিলোমিটার দূরের ছোট্ট শহর বেসান্ত নগরকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্পগুজব চলে মাসি, মামাদের সঙ্গে। ভারত থেকে বহু দূরে থেকেও চেন্নাইয়ের পরিবারকে আত্মীয়তায় বেঁধে রেখেছেন কমলা। আর সে জন্যেই হয়তো নির্বাচনের আগে বেসান্ত নগরে ধুম পড়ে গিয়েছিল মন্দিরে পুজো দেওয়ার। প্রার্থনা, যেন এই কঠিন লড়াইতেও সফলতা পায় কমলা। শেষ অবধি সত্যি হয়েছে সেই প্রার্থনা। এবার দেখার ভারতীয় বংশোদ্ভুত কমলা কতটা ধরে রাখতে পারেন তাঁর লড়াকু মেজাজ। কতটা বাস্তবায়িত করতে পারেন মায়ের স্বপ্নকে। যে স্বপ্ন বৈষম্যহীন, অহিংস এক আমেরিকা গড়ে তোলার...

তথ্যসূত্র-
১. কমলা হ্যারিস, উইকিপিডিয়া
২. পি ভি গোপালান, উইকিপিডিয়া
৩. How Kamala Harris’s Family in India Helped Shape Her Values, Jeffrey Gettleman and Suhasini Raj, NYTimes

আরও পড়ুন
১৫০ বছর ধরে মার্কিন নির্বাচনের ‘প্রতীক’ হাতি আর গাধা; কোন গল্প লুকিয়ে এর পিছনে?

Powered by Froala Editor