গীতিকার মোহিনী চৌধুরী লিখেছিলেন 'ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে'। আর কমল দাশগুপ্তের সুরে সেই গান পরিবেশন করেছিলেন জগন্ময় মিত্র। কিন্তু সেই একটি পঙক্তি যে সুরকারের জীবনের শিরোনাম হয়ে থেকে যাবে, সেটা তখন আন্দাজ করা যায়নি। তখন অবশ্য কমল দাশগুপ্ত কলকাতা কাঁপাচ্ছেন। শুধুই কলকাতা কেন, সারা দেশেই তাঁর মতো সুরকার হাতে গোনা কয়েকজনই আছেন। কিন্তু এসবের মধ্যে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছিল এক একাকী কমল দাশগুপ্ত। নিজের শিক্ষার্থীদের শিল্পী যূথিকার কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন আগেই। তার উপরে আছে সংসারের ভার। বাবা এবং দাদাকে হারিয়ে তাঁর কাঁধেই দায়িত্ব মা, ভাই এবং তিন বোনের। তবে মা এবং ভাইও বেশিদিন বাঁচলেন না। পরপর এই দুই মৃত্যু বেশ বিচলিত করেছিল কমলকে। আর ঠিক তখনই এসে হাত ধরল সেই প্রেম। যার টানে সুরের মহারাজা কমল দাশগুপ্ত হলেন পথের ভিখারি।
সালটা ১৯৫৫। প্রায় এক যুগ পর দেখা হল দুজনের। কমল দাশগুপ্ত এবং ফিরোজা বেগম। ফিরোজা তখন কলকাতায় তাঁর দিদির বাড়িতে চরম অত্যাচারের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। অন্যদিকে কমল দাশগুপ্তের জীবনেও প্রয়োজন ছিল একটি নিশ্চিত আশ্রয়। আর এভাবেই জন্ম নিল এক প্রেমের রূপকথার। দুজনের ধর্ম আলাদা। তাছাড়া ফিরোজার থেকে ঠিক ১৮ বছরের বড়ো কমল। কিন্তু এসব কোনোকিছুই তাঁদের সম্পর্কে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। দুজনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। কমলের বয়স তখন ৪৩।
বিবাহের পর দুজনে ঘর বাঁধলেন পার্ক সার্কাস অঞ্চলে। বিবাহের ঠিক ৪ বছরের মাথায় ধর্ম পরিবর্তন করলেন কমল। তখন তাঁর পরিচয় হল কামাল। আর ততদিনে কেরিয়ারের ঊর্ধ্বগামী গ্রাফ একেবারেই তলানিতে এসে ঠেকেছে। কলকাতা যেন আর তাঁকে চায় না। সঙ্গীতের জগতে এসে গিয়েছেন অনেক নতুন মুখ। অবশ্য বেশিরভাগ সুরকারকেই নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন কমল দাশগুপ্ত। কিন্তু সেই কৃতজ্ঞতার সঙ্গে খানিকটা অনুজ্ঞা মিশে থাকবে, এটা যে তাঁর সহ্য হয় না। তাছাড়া নাথ ব্যাঙ্ক ভরাডুবি হওয়ায় সমস্ত সঞ্চয়ও খুইয়েছেন। অন্যদিকে ফিরোজার তখন গগনচুম্বী খ্যাতি। কমল ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছেন ফিরোজার খ্যাতির আড়ালে।
১৯৬৭ সালে সপরিবারে সীমানার ওপারে পাড়ি দিলেন কমল দাশগুপ্ত। পূর্ব পাকিস্তানে। কিন্তু ঢাকা শহরেও কোনোরকম অভ্যর্থনা পেলেন না তিনি। পরবর্তী জীবন কাটতে লাগল অভাব আর দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে। যে কমল দাশগুপ্ত ১৯৪৬ সালে ৩৭ হাজার টাকা আয়কর দিয়েছেন, গাড়ি ছাড়া পা রাখেননি কলকাতার রাস্তায়; সেই কমল অবশেষে ঢাকায় খুললেন একটি মুদিখানার দোকান। অবশ্য তখন তিনি কামাল উদ্দিন।
আরও পড়ুন
সরে গেলেন পঙ্কজ মল্লিক, ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র সঙ্গীত পরিচালনায় ২৪ বছরের যুবক হেমন্ত
ঠিক এমনই সময় বাংলাদেশ উত্তাল আরেক স্বাধীনতার লড়াইতে। একসময় এমনই এক স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কমল দাশগুপ্ত সুর দিয়েছিলেন 'কদম কদম বাড়ায়ে যা' গানটি। নেতাজির নেতৃত্বাধীন আজাদ হিন্দ বাহিনীর সদস্যদের মুখে মুখে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছিল সেই গান। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে যেন এক চরম উদাসীনতা গ্রাস করেছে কমলকে। আর তার প্রতিফলন পাওয়া যায় ১৯৭২ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনের শিরোনাম, 'তিনি সাক্ষাৎকার দিতে চাননি'।
সুরকার কমল দাশগুপ্তের সন্ধান নিতে এসে 'পথিকার' নামে একটি মুদি দোকানের সামনে এসে রীতিমতো অবাক হয়েছিলেন সেই প্রতিবেদনের লেখক। এই নিয়ে প্রশ্ন করতেই আবেগঘন হয়ে ওঠে সুরকারের গলা। উত্তর দিলেন 'আমাকে তো সংসার চালাতে হবে। খেয়ে বাঁচতে হবে।'
আরও পড়ুন
‘ফাইনালি যখন কাজটা আমিই করছি, আমিই আবহ সঙ্গীত রচনা করি’; সুরের জাদুর সেই শুরু
কথায় কথায় উঠে এসেছিল এক গভীর অভিমানের অভিব্যাক্তি। স্পষ্ট বলে বসলেন, 'পাঁচ বছর এই দেশে আছি, কই কেউ তো কোনোদিন সাক্ষাৎকার নিতে আসেনি। কোনোদিন বেতার টেলিভিশন জানতেও চায়নি কেমন আছি? আজ এতোদিন পর কী দরকার ওসবের?' তবে শেষ পর্যন্ত আবার কাজের মধ্যে ফিরেছিলেন কমল দাশগুপ্ত। তখন গীতিকার ও বেতার শিল্পী শহীদুল ইসলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে রাজি করালেন নিজস্ব স্টুডিও এবং বিশেষ বাদ্যযন্ত্রী গোষ্ঠী গড়ে তোলার। এসবের দায়িত্ব নিলেন কমল দাশগুপ্ত নিজেই। জন্ম নিল ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস। এখানেই রেকর্ড করলেন নানা ধরনের কাওয়ালি গান। আর 'কেন এমন হয়' সিনেমাতেও সঙ্গীত পরিচালনা করলেন তিনি। এছাড়া স্ত্রী ফিরোজার নামে বাংলা আকাদেমি থেকে প্রকাশ করলেন 'নজরুল গীতিমালা'। প্রতিটা স্বরলিপির চিহ্ন এবং কৌশল তাঁর নিজের আবিষ্কার।
তবে শেষ পর্যন্ত আর স্রোতে ফিরতে পারেননি। দীর্ঘদিনের অনিয়মে শরীর ততদিনে ভেঙে পড়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। তারপর আর উঠলেন না। ১৯৭৪ সালের ২০ জুলাই এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন তিনি। সেই কমল দাশগুপ্ত কি শেষ জীবনে বলেছিলেন, 'পৃথিবী আমারে চায় না'?
আরও পড়ুন
১৪টি দেশের ৩২৫ জন শিল্পী জুড়লেন গানে, লকডাউনে বিশ্বরেকর্ড ভারতীয় সুরকারের
১৯১২ সালে ২৮ জুলাই বাংলাদেশের কালিয়া থানার বেন্দা গ্রামে জন্ম কমল দাশগুপ্তের। ছোট থেকে কখনওই আর্থিক অনটন তাঁকে বুঝতে হয়নি। পরিবারের প্রত্যেকেই জড়িয়ে ছিলেন সঙ্গীতের সঙ্গে। সেই সূত্রেই যোগাযোগ তাঁর। এরপর পরিচয় নজরুল ইসলামের সঙ্গে। পরিবারের বাকিদের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল বিদ্রোহী কবির। তবে কমল দাশগুপ্ত ছিলেন কবির সতীর্থ। দিজনেই সঙ্গীত শিক্ষা লাভ করেছেন ওস্তাদ জমিরুদ্দিন খানের কাছে। কবি নিজে ছাড়া তাঁর সবথেকে বেশি গানের সুর হয়তো কমল দাশগুপ্তই দিয়েছিলেন। অন্তত ৪০০টি নজরুল গীতি এবং অসংখ্য আধুনিক ও সিনেমার গানে সুর দিয়েছেন প্রথম জীবনে। প্রতি মাসে গড়ে ৪৫টি করে গানের সুর দেওয়ার রেকর্ড তাঁর। শুধু এইচ এম ভি-র জন্যই সুর দিয়েছেন ৭ হাজারের বেশি গান। অত সেই কমল গানের সরোবরে তলিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তাঁর সুর দেওয়া গান থেকে গিয়েছে। আর থেকে গিয়েছে এক বিষম প্রেমের অমর কাহিনি।
তথ্যসূত্রঃ প্রথম আলো, সাপ্তাহিক বিচিত্রা
আরও পড়ুন
প্রাণ কাড়ল করোনা, চলে গেলেন সুরকার সাজিদ-ওয়াজিদ জুটির ওয়াজিদ খান
Powered by Froala Editor